
বড়ই বিচিত্র মনুষ্য চিন্তাধারা। অন্যরা করলে যেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, নিজের বেলায় তা শতভাগ যথার্থ। নিজে গাড়িতে থাকলে রিক্সাওয়ালার আচরণকে অসহ্য মনে হয়। আবার নিজে রিক্সা আরোহী হলে প্রাইভেট কারের আরোহীর আচরণকে মনে হয় দাম্ভিকতার চূড়ান্ত। উল্কার বেগে চলন্ত আন্তঃজেলা বাসের যাত্রী হিসেবে পথচারী বা ভ্যানওয়ালাকে বেকুব বলতেও দ্বিধা করি না। আবার নিজে রাস্তায় থাকলে ওই বাসগুলোকেই মৃত্যুদূত উপাধি দিতে ছাড়ি না।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। প্রায়ই খবরে পড়ি বা দেখি চালকের বেপরোয়া গতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় এতজন নিহত বা এতজন আহত। অথবা চালকের অসাবধানতার কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনা ইত্যাদি। ঠিক মনে পড়ছে না দেখেছি কিনা যে, পথচারীর অসাবধানতায় দুর্ঘটনা বা ভ্যানচালকের ভুলে দুর্ঘটনা ইত্যাদি। বলতে চাচ্ছি, সড়ক দুর্ঘটনা কি শুধুমাত্র বাস, ট্রাক বা মাইক্রোবাস চালকের বেপরোয়া গতি বা অসাবধানতার কারণেই ঘটে? এখানে আপনার বা আমার মতো পথচারীদের কি কোন দায়িত্বই নেই ?
ঢাকা শহরের যে কোন রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরতে শুরু করবে। সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলেছে, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এরই মাঝে কিছু মানুষকে দেখবেন, যারা মোবাইল আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে নিজ বাড়ির আঙ্গিনা মনে করে রাস্তা পার হচ্ছেন। রাস্তায় গাড়ির গতি যত বেশি, তাদের রাস্তা পার হওয়ার গতি ততই মন্থর। অনেকে দয়া করে একবার হাত উঁচু করে থাকেন, অনেকে তাও করেন না। অনেকে আবার উট পাখির বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মতো ডানে-বামে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করেন না। সকলের মনোভাব এক। তাকে সুষ্ঠুভাবে রাস্তা পার করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব যেন গাড়ি চালকের।
ঢাকা শহরে বিপুল টাকা খরচ করে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। কতজন পথচারী তা ব্যবহার করেন তা জানা নেই। তবে বিপুল সংখ্যক পথচারী যে ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপার করেন, তা সকলেরই জানা আছে। জীবন চলে যায় যাক, তবু কয়েকটা ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কষ্টটা করব না। এই কষ্ট লাঘবের জন্য করা হলো আন্ডারপাস। তাতেও কষ্ট। তাই ফুটওভার ব্রিজগুলো আজ ফেরিওয়ালা বা ভিখারির দখলে আর আন্ডারপাসগুলো মাদকসেবীদের। শুধু ঢাকা সেনানিবাসের ফুটওভার ব্রিজগুলোর যথার্থ ব্যবহার দেখা যায়। তাও মাঝে মাঝে কর্তব্যরত এমপিকে মাঝ রাস্তা থেকে পথচারীদের ফেরত পাঠাতে হয়।
এবার আসি দূরপাল্লার যাত্রার কথায়। আন্তঃজেলা বাসগুলোর অনিয়ন্ত্রিত গতি এবং বেপরোয়া চালনার ব্যাপারে প্রায় সকলেরই কিছু ধারণা আছে। কয়েকটি পরিবহন তো এ ব্যাপারে ‘ব্র্যান্ড নেম’ অর্জন করেছে। রাস্তা ব্যবহারকারী অন্যরাও কম যান না। দুরন্ত গতিতে বাস আসছে, কিন্তু ভ্যানচালক কিছুতেই বামে চেপে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বাসটাকে যাওয়ার সুযোগ দেবে না। হাইওয়ের দু’পাশ জুড়েই বাজার এবং লোকালয়। এসব স্থানের লোকজনও রাস্তা পারাপারে তেমন সচেতন নন। একটা বিশেষ অঞ্চলের লোকদের দেখেছি, রাস্তার কিনারে কয়েকজন বসে গল্প করতে। দুরন্ত গতিতে গাড়ি আসলেও সরে বসা তো দূরের কথা, শুধু পিঠ ও মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দেন। অনেকে মজা করে বলেন, ‘এই এলাকার লোকজন চলন্ত গাড়ির হেডলাইট দেখে রাস্তা পার হয়।’ তবে হাইওয়েতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে ক্রস রোডগুলো। গ্রামের বা মফস্বলের যে রাস্তাগুলো হাইওয়েকে আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করেছে। প্রায়ই দেখা যায় মোটরসাইকেল আরোহী ঘাড়ের সহায়তায় কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে কাত হয়ে বসে নিবিষ্ট মনে গল্প করতে করতে হাইওয়ে পার হচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই হাইওয়ের মাঝ পথে এসে তার পরে বামে-ডানে তাকান। অনেকে আবার কোন দিকে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করেন না। আবার দেখা যায় কেউ স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ পুরো পরিবার এক মোটরসাইকেলে নিবিষ্ট মনে রাস্তা পার হচ্ছে। চির সবুজ বাংলাদেশের রাস্তার দু’পাশ জুড়ে গাছপালা এবং ক্রস রোডগুলোর কোনায় কোনায় দোকানপাটগুলোর কারণে হাইওয়ের চালক আগে থেকে দেখতেও পান না, কেউ আসছে কিনা। তা ছাড়াও উঠতি বয়সের তরুণদের তিনজন মিলে এক মোটরসাইকেলে হাইওয়েতে ফর্মুলা ওয়ানের মহড়া তো অহরহই চোখে পড়ে। এরা ফর্মুলা ওয়ানের প্রতিযোগীদের চেয়েও সাহসী, তাদের হেলমেট লাগে না।
কারও পক্ষ নিচ্ছি না। গাড়ি চালকের অসাবধানতা এবং বেপরোয়া গতির কারণেই অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে আমরা নিজেরা সচেতন হলে এর সংখ্যা কমানো যায়। বাসযাত্রীর হাত, মাথা জানালা দিয়ে বাইরে না রাখলে দুর্ঘটনার সুযোগ বা সম্ভাবনা কমে যায়। চলন্ত বাসের দরজার হ্যান্ডেলে না ঝুলে একটু অপেক্ষা করে পরের বাসে উঠলেই ঝুঁকিটা কমে যায়। রাস্তা পারাপারের সময়ে মোবাইল ফোনে মনোসংযোগ না করে ডানে-বামে দেখা উচিত। হাইওয়েতে অধিক সতর্কতা এবং সচেতনতা প্রয়োজন। রাস্তা অতিক্রম করার সময় আগে থেমে, ডানে-বামে দেখে তারপরে পার হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে হাইওয়েতে বাস বা ট্রাকগুলো অনেক বড় গাড়ি, যা একটা নির্দিষ্ট গতিতে থাকলে হঠাৎ করে থামানো বা নিয়ন্ত্রণ করা চালকের জন্য খুব কঠিন।
অনেক কালক্ষেপণ এবং নাটকীয়তার পরে বাংলাদেশ মোটরযান আইন-২০১৮ অবশেষে গত নবে¤¦র ২০১৯-এ আলোর মুখ দেখেছে। অনেক আইন সময়োপযোগী করা হয়েছে এবং মোটরযান সংক্রান্ত অপরাধগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এখানে চালকের বিভিন্ন অপরাধে বিভিন্ন ধরনের জরিমানা রাখা হয়েছে যার অঙ্কটা মোটামুটি ভালই। মারাত্মক চালনায় প্রাণহানির কারণে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ও রাখা হয়েছে। কয়েক ধরনের অপরাধকে জামিন অযোগ্য অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণী করা হয়েছে, ইতোপূর্বে শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ ছিল না। এই আইন নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে সাধুবাদ জানালেও জরিমানার অঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক গাড়ির মালিক অগ্রিম আয়কর মওকুফের পক্ষেও বলেছেন। তবে আইনের প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। আবার সংশোধনের প্রস্তাবও উঠেছে।
আইন প্রণয়ন হবে, তার প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নও হবে। তবে একটা বিষয় আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে, দুর্ঘটনা যার কারণেই ঘটুক না কেন ক্ষতি নিজেরই। দুর্ঘটনায় গাড়ি চালকের বিচারে শাস্তি হবে, এমনকি মৃত্যুদ-ও হতে পারে। ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবারকে মালিক পক্ষ অনেক টাকা ক্ষতিপূরণও দিতে পারে। কিন্তু যার ক্ষতি হয়েছে তা কোন দিনও পূরণ হবে না। দুর্ঘটনায় যিনি মারা গিয়েছেন তিনি কোনদিন ফিরে আসবেন না। যিনি হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন, তিনি কোন দিনও স্বাভাবিক জীবন তিনি ফিরে আসবেন না। দোষ যারই হোক-মনে রাখতে হবে যে, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’
লেখক : চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত