ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

দুর্নীতিবিরোধী ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ১৯:০০, ৭ আগস্ট ২০২০

দুর্নীতিবিরোধী ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ অর্থে মন্তব্য করেছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাঙালীর জন্য ডেকে আনে মহাবিপর্যয়। সপরিবারে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতিপথ ও প্রয়াসে কফিনের শেষ পেরেকটুকু মেরে দিয়েছিল মানুষরূপী শয়তানরা, যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। এতে চরম ডান ও চরম বাম উভয় গ্রুপের মধ্যে এক আশ্চর্য রকমের মিলন দেখা গিয়েছিল। পরবর্তী একুশ বছর ছিল পেছনের দিকে দেশকে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত। আগস্ট মাস বাঙালী জাতির জন্য নিষ্ঠুর মাস। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য নেতৃত্বের সূচনা। যদি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হতো, তবে বাঙালী জাতি কখনও স্বাধীনতার সূর্যতাপ অনুভব করতে পারত না। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কালে বঙ্গবন্ধুর জীবনকে চারটি স্তরে বিস্তৃত করা যায় : তৈরি হওয়া, নেতৃত্বের বিকাশ, নেতৃত্ব গ্রহণ, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ প্রয়োগ। সততা, মেধা-মনন দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ও জনগণের কল্যাণ সাধনে সব সময়েই ছিলেন আপোসহীন। তবে তিনি ছিলেন একজন মুক্ত মনের স্বাধীনচেতা বজ্রনিনাদকারী পুরুষ। অন্যের জীবন দর্শনকে তিনি শ্রদ্ধার হলে শ্রদ্ধা করেছেন। আবার অন্যায্য হলে বিরোধিতা করেছেন। কিসে বাঙালীর ভাল হবে সে জন্য নিজস্ব দর্শন অনুযায়ী সদা মানুষের হিতসাধনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি এদেশের আবহমান কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জীবিতকালে যেমন আপোস করেননি, এমনকি মৃত্যুর সময়েও তার নীতিতে অবিচল ছিলেন। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বাঙালী জীবনে হতাশা নিয়ে এসেছিল। শেখ কামাল এবং শেখ জামাল তার উচ্চ হৃদয়েরই প্রতিনিধিত্ব করতেন বলে তারা অতি সহজেই শত্রুপক্ষের টার্গেট ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি প্রফেসর ড. মোঃ আমির হোসেন ছিলেন শেখ কামালের অত্যন্ত অনুরক্ত। প্রফেসর ড. মোঃ আমির হোসেন শেখ কামাল সম্পর্কে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মূল্যায়ন করেন যে, খাঁটি বাঙালী আদর্শে যোগ্য পিতার যোগ্য মানসপুত্র ছিলেন। ব্যক্তিগত সততায় তিনি ছিলেন আকাশ সম উচ্চতায়। শেখ কামালও পিতার মতো কখনও অন্যায়কে বরাদাশত করতে পারতেন না। মাত্র দশ বছরের শিশু শেখ রাসেলকে যারা হত্যা করল, তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ ছিল না। আর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সকল সুখ-দুঃখের অংশীদার, তিনি কি কারণে নৃশংসতার শিকার হলেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটি কথাই বার বার মনে হয়- যা কিছু ভাল, যা কিছু সত্য-ন্যায় তার প্রতি মূর্ত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ভালবাসা। এ ক্ষেত্রে বঙ্গমাতা ছিলেন আদর্শের প্রতীক। আর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি বাংলার প্রতি, স্বদেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসাকে সহ্য করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মর্মান্তিক ঘটনার দু’দিন আগেও কুমিল্লা শহরে অনেক নেতা-নেত্রীকে মুখে ফেনা তুলতে দেখা যেত, মুহূর্তের মধ্যে তারা উধাও হয়ে গেল। আমাদের কুমিল্লার পূর্ব বাগিচা গাঁওয়ের বাসায় সেদিনই আমার বাবা মোবাশ্বের আলী বাসার নিকট মসজিদের মৌলভী সাহেবকে ডেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য বাদ আছর দোয়া খায়ের করিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক এরপর টিকটিকি লেগে গেলেও আব্বা কিন্তু ভয় পাননি। বেশ কয়েকবার এসবি থেকে লোক এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমার বাবা সব সময়ে একটি কথা বলতেন, যিনি বাঙালী জাতিকে অকৃপণভাবে দিয়েছেন, তার মর্মান্তিক মৃত্যুতে দোয়া-খায়ের করা কি অন্যায়? সৌভাগ্যবশত এসবির ইন্সপেক্টরের সন্তানরা আব্বার ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যু মানুষকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কেবল স্বদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বে মানুষের মানবতার কল্যাণের অগ্রদূত ছিলেন। যারা শেখ মুজিবকে নানা উছিলায় স্বাধীনতার পূর্বে মারতে চেয়েছিল, তাদের সহজে চিহ্নিত করা যায়। অথচ জিয়া-মোশতাক-চাষী এরা সবাই তো বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুকূল্য নিয়েছেন। এমনকি জিয়া বাকশালের সদস্য পদও গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার মাধ্যমে তার আদর্শকে দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। কোন কোন পত্রিকার রিপোর্টে এমনও দেখা যায়, মোশতাক আর ভুট্টো দু’জনের আবার কনফেডারেশন করার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু জনরোষের ভয়ে মোশতাক আর সেদিকে এগুতে সাহস পায়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ। তার মতো প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বকে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতি চর্চায় মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল হত্যাকারীরা। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিতে আমি পরিবারসহ আমার জন্মস্থান বাগিচাগাঁও কুমিল্লায় গিয়েছিলাম। আসলে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করে আসছি। এ ক্ষেত্রে আমার পিতা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন উৎসাহ যুগিয়েছেন। আমার পিতা সব সময়ে বলতেন, স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশ কখনও বিকাশ লাভ করতে পারত না, যদি বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে দেশের মুক্তি সংগ্রামের পথকে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে না নিতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসা থেকেই তার ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে মোবাশ্বের আলী বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্ব গুণে জেলে থেকেও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কথা বার বার বলতেন। কুমিল্লায় গেলে ১৬ মার্চ, ২০২০ কুমিল্লা সদরের এমপি মহোদয় বাহার ভাইয়ের সঙ্গে তার ব্যস্ত কর্মসূচীর মধ্যেও দেখা করি। তার বড় ভাই সেলিম ভাই ছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব। অসুস্থ অবস্থায় তাকে দেখে মন খারাপ লাগে। আরেক ভাই হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। সেলিম ভাইয়ের ছেলে কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, যেভাবে করোনা থেকে মানুষকে সাবধান করছে দেখে ভাল লাগল। বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ সেই আদর্শ অনুসরণ করেই তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। সে জন্যই ইতোপূর্বে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলাম ‘বঙ্গবন্ধু থেকে অবিসংবাদিত নেত্রী শেখ হাসিনা।’ যেভাবে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির জন্য কাজ করেছেন, জন্মবার্ষিকীতে করোনাকালেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে তাঁকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করে স্মরণ করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা ব্যক্তি পর্যায়ে জানানো হবে, যাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সর্বদা উচ্চকিত ছিলেন-ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মজুতদার, কালোবাজারি এবং পরের জমি দখলদারদের বিরুদ্ধে বার বার সতর্কতা এবং শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন। এই গিরগিটিদের শৈশব-কৈশোরে দেখেছি রং বদল জিয়ার সহযোগী হতে। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী রাশেদ চৌধুুরীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা আবশ্যক। জিয়া যে অন্যায় করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রে, তা আরও পাকাপোক্ত করেন ইনডেমনিটি বিল পাস করে। দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির স্রোতের বিকাশ সাধন করেন তিনি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যেখানে বাঙালী সত্তার বিজয় অর্জিত হয়, পরবর্তী একুশ বছর তা থেকে দূরে সরে যায় পরবর্তী শাসকবর্গ। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে শ্রমিক কৃষক নিষ্পেষণ শুরু হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু কৃষকদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। শ্রমজীবী মানুষ যাতে ভাল থাকেন সে জন্য তিনি তাদের মৌলিক অধিকারসমূহ পূরণে সচেষ্ট থাকতেন। সে সময়ে সিরাজ সিকদার যেভাবে অন্যায়-অত্যাচার করেছে তা কহতব্য নয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতীয়তাবাদকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন- গণতন্ত্রের বিকাশমান ধারক ও বাহক ছিলেন তিনি। তিনি রাজনীতি করেছেন দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য। তাই তো ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানী আমল এবং বাংলাদেশ আমলে জনকল্যাণে তিনি ব্রতী হয়েছেন। তবে দুর্ভাগ্য এদেশে কখনও বিশ্বাসঘাতকের অভাব হয় না। আর তাই এরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে বিশ্বাসঘাতকতা করতে। সেদিন স্বাচিপের একজন সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। পরিবারের একমাত্র তিনি ছাড়া সবাই পূর্বে মুসলিম লীগের আমলে মুসলিম লীগার, পরবর্তীতে ধর্ম ব্যবসায়ী এবং বিএনপি সমর্থক। আসলে যাদেরকে বিভিন্ন পদে অলংকৃত করা হবে আওয়ামী লীগকে তাদের পারিবারিক ইতিহাসটি একটু দেখা দরকার। নইলে এক ধরনের মাফিয়া নেক্সাস তৈরি হয়ে একজন আরেকজনকে অন্যায় প্রটেকশন দিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় গুণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে মানুষের মঙ্গল সাধন করা। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বাঙালীর প্রতি ভালবাসা। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, কিন্তু শাস্তি কার্যকর করা যায়নি তাদের বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত এনে শাস্তি দাবি করা দরকার। গুটিকয়েক লোক ছাড়া অন্য সবাই সময়ের ব্যবধানে ভোল পাল্টে ফেলেছিল। এটি আসলে আমাদের জাতীয় সমস্যা। যারা এখনও পরের সম্পদ আত্মসাত করে, বর্তমান সরকারপ্রধান তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্যা হলো যখন দুর্নীতি উদ্ঘাটন করে, তখন একটি শ্রেণী পূর্ব থেকে বসে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে বলার জন্য। এরকম হলে তো রাষ্ট্রেরই ক্ষতি। বঙ্গবন্ধু কন্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার পিতার মতো আপোসহীন। বর্তমান আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগে অধিকাংশই নেত্রীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাল মানুষ। তবে যারা দুর্নীতি করবে, জঘন্য ঘৃৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে, তাদের কঠোর হস্তে দমনের প্রয়াস অব্যাহত থাকতে হবে। অন্যের জমি দখলের জন্য, প্রণোদনার টাকা মেরে দেয়ার জন্য, দুর্নীতির জন্য, মজুতদারদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা যেতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীরা যুগে যুগে ছিল। আছেও। বঙ্গবন্ধু সবসময়ে জনকল্যাণের বিষয়টি ভাবতেন। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও জনকল্যাণের বিষয়টি ভাবেন সর্বদাই। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট, আইটি এক্সপার্ট [email protected]
×