ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

বহুজাতিকতার অভিযাত্রা

প্রকাশিত: ২১:০৯, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

বহুজাতিকতার অভিযাত্রা

সিডনির মেলব্যাগ

বিখ্যাত লেখকরা মনে করতেন বা করেন মানুষ মূলত এক পরিযায়ী পাখি। তার উড্ডয়ন পাখির ডানার চাইতেও তীব্র গতির হতে পারে। কারণ, একমাত্র মানুষই পারে ভাষা ও ইন্দ্রিয়ের ভেতর দিয়ে যোগাযোগ গড়ে তুলতে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের যে উন্নতি-অগ্রগতির কথা শুনি এবং দেখি তার সঙ্গে এর যোগ ঘটুক। সিডনিতে বিনোদনের পাশাপাশি এমন মহতী কাজ শুরু হোক। হলে আমাদের সবার লাভ। জাতি, দেশ ও সমাজের লাভ। যার মানে এই আমাদের নারীরা বিশ্বায়নের খোলা জানালায় 
মুখ রেখে জানবে দেশ ও বিদেশের বাঙালি এক ও অভিন্ন

দেশের বাইরে বিশেষ করে সিডনিতে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নীরব বিপ্লব ঘটে চলেছে। সেদিন আবারও তা টের পেলাম। পড়ুয়ার আসর নামে যে সংগঠন তাদের ঈদ পুনর্মিলনী আর একটি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম নারীশক্তির উদ্ভাবন। দেশে যখন নারীদের জয়জয়কার তখন বিদেশে নারীরা পিছিয়ে থাকবে কেন? পড়ুয়া শব্দটি যখন চালু হয় তখন আমরা কেবল বই পড়তাম।

ডিজিটাল মিডিয়ার আক্রমণ তখন আমাদের সমাজে আঘাত হানেনি। দূর সিডনিতে একদল পড়ুয়া যখন প্রথম দাওয়াত দিয়েছিলেন একটু অবাকই হয়েছিলাম। দূর দেশে ‘পড়ুয়ার আসর?’ গিয়ে বুঝলাম নারী ও তার শক্তি কতটা অসাধারণ। জানলাম রোকেয়া আহমেদ, কাশফি আসমা আলম, নাসরীন মোফাজ্জল, সাকিনা আক্তার, রুমানা ফেরদৌস লনি, আজিজা শাহদাতসহ যাদের আমি চিনতাম তারা কেবল পড়ে না, পড়ায়ও। এই পাঠ তাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। বেগম রোকেয়া দিবস, বঙ্গবন্ধুকে স্মরণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের পাঠ আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছে।

গত রবিবার ফের গিয়েছিলাম তাদের ঈদ আনন্দ আর একটি পুস্তকের আলোর মুখ দেখা নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। ‘আরশিতে মুখ’ নামের একটি নিবন্ধের বই লিখেছেন রোকেয়া আহমেদ। এবারের বইমেলায় বের হয়েছে এটি। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ আর সুলিখিত গদ্যে যে কটি লেখা পড়েছি তাতে আমি নিশ্চিত লিখলে রোকেয়া অনেক দূর যেতে পারবেন। তার গদ্যশৈলী ও ভাবনায় আধুনিকতার সঙ্গে জীবনের যোগ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃতী ছাত্রী ও একদা শিক্ষক রোকেয়া চাইলেই বইটির নাম আরশি পরিহার করে দর্পণ বা প্রতিবিম্ব ব্যবহার করতে পারতেন। কেন করেননি বুঝলাম না।
সেদিনের দুপুরটি নানাভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তাদের আন্তরিকতা, গান, জমজমাট খাবারে মন ও রসনার তৃপ্তি নিয়েই ঘরে ফিরেছিলাম। বলাবাহুল্য, বহু গুণী মানুষের পাশাপাশি সঙ্গে ছিলেন সংগঠক নেতা অগ্রজ বন্ধু গামা আবদুল কাদির। চমৎকার কবিতা পাঠ করলেন মেলবোর্নের তরুণ মোর্শেদুল মাহমুদ শান্ত। যথারীতি কথা বলেছিল সংগঠক নোমান শামীম। রবীন্দ্রনাথ ও পদ পড়েননি। তাঁর কবিতা পাঠ করেছিলেন নুরুন্নাহার বেগম বিউটি। মানুষ এখন বই পড়ে না এই ভ্রান্ত ধারণা মিথ্যা করে চলা সিডনির পড়ুয়ার আসরের জন্য রইল ভালোবাসা।
এখন কথা হচ্ছে এই শক্তির ভবিষ্যৎ কি? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তারা? আজকাল নারীশক্তির উদ্ভাসের পাশাপাশি আমরা আরও যে বিষয় টের পাই বা দেখি তা হলো- তাদের অপমান। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সময় সুযোগ মিললেই তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিদেশের মাটিতে যা অসম্ভব। কারণ উদার গণতান্ত্রিক সমাজে তাদের বাধা দেওয়ার সাধ্য নেই কারও। যে সমাজে সমকামী বা লিঙ্গান্তর সাধারণ ঘটনা এবং যেখানে মানুষ কোনোভাবেই তার লিঙ্গ বা ধর্ম পরিচয়ে বড় হয় না কিংবা বসবাস করে না, সেখানে তারা আসলেই স্বাধীন। 
আমাদের সমাজের একদল অন্ধ মানুষ তা মানতে নারাজ। যে কথা বলছিলাম, বিদেশের মাটিতে যে মিনি বাংলাদেশ বাংলা সংস্কৃতি তার দায়িত্ব দেশের পাশে দাঁড়ানো। কিভাবে তা সম্ভব? যারা বেগম রোকেয়ার উত্তরাধিকারী, যারা জাহানারা ইমাম বা প্রীতিলতার গৌরবে দীপ্ত, তাদের সময় সামনে আসার। দেশ-বিদেশের যোগসূত্র এখন সময়ের ব্যাপার।

চাইলে যে কোনো সময় আমরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। এই সংযুক্তি একদিকে যেমন আশার, তেমনি হবে সাহস বিনিময়ের যোগসূত্র। গণতান্ত্রিক সমাজ ও উদার দেশের বাঙালি নারীদের কাজ হবে দেশের কল্যাণে সংস্কৃতির মুক্ত হাওয়া নিশ্চিত করার ব্যাপারে কাজ করা।
ইউরোপ-আমেরিকার পর অস্ট্রেলিয়ার সমাজে আমাদের অবস্থান ক্রমেই বলিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এটা যে কথার কথা না তার প্রমাণ ক্রমবর্ধমান অনুষ্ঠান আর আয়োজন। এক সময় যা ছিল ঘরোয়া তা এখন ঘরের বাইরে মাঠ-ময়দান পেরিয়ে ছুটে চলেছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। বহুজাতিক মিশ্র সংস্কৃতি যে কী সেটা আসলে দেশের আমজনতা তেমন একটা বোঝে না। এর জন্য তাদের দায়ী করা অনুচিত। ভৌগোলিকভাবে ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ। মোটামুটি এক ভাষা, ধর্ম ও আচরণের মানুষে ঠাসা এক জনপদ। সেখানে ভারতীয়, পাকিস্তানি বা ভুটানিরাও বিদেশী। গাত্রবর্ণ থেকে ভাষা বা খাবার সবকিছুতেই আমরা তাদের চাইতে আলাদা। দু’চারটি নামি-দামি রেস্তোরাঁ বা শখ করে কিছু বিদেশী খাদ্য খাওয়ার নাম বহুজাতিকতা নয়। বহুজাতিকতা একটি শক্তি। যারা দেশের বাইরে বসবাস করেন তারা এটা জানেন। তারা মূল স্রোতে মিশতে গিয়ে বুঝতে পারেন নিজেদের আসল শক্তি ও সামর্থ্য কোথায়।

এইটুকুতেই তার আত্মপরিচয় বেরিয়ে পড়ে। জেনে যায় শক্তি ও নিজের সীমাবদ্ধতার তফাৎ। এমন অভিজ্ঞতালব্ধ যে কেউ পারেন চাকা ঘোরাতে। পড়ুয়ার আসর নামে যে সংগঠন তার অন্যতম একজন রোকেয়া আহমেদ। রোকেয়ার সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের সবাইকে দেখে জেনে মনে হয়েছে, তারা পারবেন দেশের নারীদের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তুলতে।
সময় বসে থাকে না। বিখ্যাত লেখকরা মনে করতেন বা করেন মানুষ মূলত এক পরিযায়ী পাখি। তার উড্ডয়ন পাখির ডানার চাইতেও তীব্র গতির হতে পারে। কারণ, একমাত্র মানুষই পারে ভাষা ও ইন্দ্রিয়ের ভেতর দিয়ে যোগাযোগ গড়ে তুলতে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের যে উন্নতি-অগ্রগতির কথা শুনি এবং দেখি তার সঙ্গে এর যোগ ঘটুক। সিডনিতে বিনোদনের পাশাপাশি এমন মহতী কাজ শুরু হোক। হলে আমাদের সবার লাভ। জাতি, দেশ ও সমাজের লাভ। যার মানে এই আমাদের নারীরা বিশ্বায়নের খোলা জানালায় মুখ রেখে জানবে দেশ ও বিদেশের বাঙালি এক ও অভিন্ন।[email protected]

×