ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

তাপপ্রবাহের চড়া মূল্য

-

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

তাপপ্রবাহের চড়া মূল্য

সম্পাদকীয়

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখের খররৌদ্রকে উদ্দীষ্ট করে লিখেছিলেন দারুণ অগ্নিবাণ হানে। অধুনা বাংলাদেশ তথা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে যে নিদারুণ নিষ্করুণ তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তাতে সর্বস্তরের মানুষ বিষয়টি টের পাচ্ছেন হাড়ে হাড়ে। ঢাকাসহ দেশের প্রায় সর্বত্র বর্তমানে উত্তপ্ত চুল্লির অবস্থা বিরাজমান। তাপমাত্রা ইতোমধ্যেই ৪২-৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে।

আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে মে-জুন পর্যন্ত। মাঝে-মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে কালবৈশাখী, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকলেও এবারের গ্রীষ্মকাল হবে প্রলম্বিত ও দীর্ঘস্থায়ীÑ যা জনজীবনে বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকায় প্রতিবছর উৎপাদনশীল খাতে ক্ষতি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু পোশাক খাতেই ক্ষতি হবে ৬০০ কোটি ডলার। এর ফলে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন প্রায় আড়াই লাখ পোশাককর্মী। মনে রাখতে হবে যে, পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী প্রধান খাত। বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট আয়োজিত এক আলোচনাসভায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।

তাপপ্রবাহকে সরকারিভাবে দুর্যোগ ঘোষণার দাবিও উঠেছে। যদিও এখন পর্যন্ত এটি হিট এ্যালার্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাপপ্রবাহের কারণে যে সব শ্রমজীবী প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু সম্পর্কিত নীতিমালায় তাপপ্রবাহ নিঃসরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। এও বলা হয় যে, চলতি তাপপ্রবাহের কারণে এপ্রিল-মে মাসে শ্রমিকরা তাদের মোট কর্মঘণ্টার ২৫ শতাংশ হারাতে পারেন। এর ফলে, প্রাক্কলিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ কোটি টাকা। 
সর্বাধিক সঙ্গিন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার জনজীবন। ঢাকা এমনিতেই জনভারাক্রান্ত। দিনে দিনে পরিণত হয়েছে একটি অপরিকল্পিত কংক্রিটের জঞ্জালে। যেখানে প্রতিদিন নাগরিকদের বসবাস করতে হয় জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে। সড়ক দুর্ঘটনা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, অগ্নিদুর্ঘটনা, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত্যু, লোডশেডিং, পানি দূষণ ও সংকটে এমনিতেই রয়েছে নৈমিত্তিক ঝুঁকি।

ভয়াবহ তাপপ্রবাহ এতে যোগ করেছে মাত্রাতিরিক্ত দুর্ভোগ, যা জনজীবনকে প্রায় অচল ও অসহনীয় করে তুলেছে। রাজধানীর প্রাণপ্রবাহ বলে বিবেচিত ৪টি নদীÑ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী ইতোমধ্যেই দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়। খালগুলো অধিকাংশই বর্জ্য নিক্ষেপে ভরাটসহ হয়েছে বেদখল। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে গাছপালা নেই বললেই চলে। খেলার মাঠ ও পার্কগুলো অদৃশ্যপ্রায়। সেসব স্থানেও গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। ফলে, সূর্য প্রতিদিন যে বিপুল বিক্রমে তাপ বিকিরণ করে থাকে, তা জমে থাকে ভূতলে।

প্রতীয়মান হয় যে, রাজধানী যেন একটি উত্তপ্ত কড়াই অথবা চুল্লিবিশেষ। তদুপরি রাজধানীর চারপাশ ঘিরে অবৈধ ইটভাঁটির তা-ব তো আছেই। সে অবস্থায় ঢাকা যে অচিরেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। 

রাজধানীর এহেন হাঁসফাঁস তথা দুরবস্থা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ নেই। সংশ্লিষ্টরা পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ তথা পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার কথা বলছেন। বলা হচ্ছে বেশি বেশি গাছ লাগানোর জন্য। খালগুলো উদ্ধারের কথাও। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার কথাও বলা হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও বলতে হয় যে, তেমন কোনো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে রোডম্যাপ দৃশ্যমান হচ্ছে না কোথাও।

×