ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আমজাদ খান

স্মরণ ॥ ভাওয়াল বীর শহীদ ময়েজউদ্দিন

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

স্মরণ ॥ ভাওয়াল বীর শহীদ ময়েজউদ্দিন

১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শহীদ ময়েজউদ্দিনের জন্ম। কালীগঞ্জ সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে আইএ, ১৯৫৩ সালে অনার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢাবি) ও ১৯৫৫ সালে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে (ঢাবি) থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই ময়েজউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবন শুরু ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে। তখন শহীদ ময়েজউদ্দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’-এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। শহীদ ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গা দখল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রধান অবস্থানে এসে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে আপোস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে এসে সবকিছু ভ-ুল করতে চেয়েছিল। খন্দকার মোশতাক দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভার আয়োজন করেন কলকাতার থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় ভবনের ছাদে। সেই সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ভোটাভুটির জন্য ডিভিশন চাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সত্তরের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেনÑ ‘কোন ডিভিশন নয়, কিসের ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন মূল্যে দলের অবস্থান যা আছে তা-ই থাকবে, কোন নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই ওঠে না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনীচক্র খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। এরপর মোশতাক সংসদ সদস্যদের সভা ডেকে ঘাতকদের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেই সভায়ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন সবাইকে হতবাক করে চিৎকার করে বলেছিলেনÑ ‘খন্দকার মোশতাক আহমেদ অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তার কোন নেতৃত্ব মানি না, সে খুনী, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামী লীগ তার কোন নেতৃত্ব মানতে পারে না। ময়েজউদ্দিন ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফপিএবির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওচচঋসহ ওঙজ-এর সদস্য ছিলেন। জবীবড়-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু নিয়ে জাতিসংঘ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ’৮০-এর দশকেই এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তখনই তিনি কালীগঞ্জে নিজ জায়গায় ৩টি মাতৃসদন স্থাপন করে গেছেন। ওই সময়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ ছাড়া শহীদ ময়েজউদ্দিন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সমাজসেবক হিসেবে পৃথিবীর বহুদেশে সভা-সেমিনার এবং সম্মেলনে যোগদান করেছেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। দেশব্যাপী ২২ দল আহূত হরতাল চলছে। কালীগঞ্জে ময়েজউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। আর তখনই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেয়া কতিপয় সন্ত্রাসী তাঁর ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। কালীগঞ্জের রাজপথ তাঁর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়। এই হত্যাকা- সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশে তাঁর হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলন অবশেষে সামরিক শাসকের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। গণতন্ত্রের জয় হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের কথা স্মরণ রেখেই হয়ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ময়েজউদ্দিন কন্যা মেহের আফরোজ চুমকীকে ১৯৯৬ সালে গাজীপুর-নরসিংদী জেলার সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি মনোনীত করেছিলেন। পরবর্তীতে নিষ্ঠা, সততা, কর্মদক্ষতা যোগ্যতা ও দূরদর্শিতার কারণে তিনি পর পর তিন বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আজ ৩৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতে শহীদ ময়েজউদ্দিনসহ সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকা
×