ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কবীর চৌধুরী তন্ময়

সুষম খাদ্য-মানসম্মত ওষুধ মানুষের অধিকার

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২৮ জুলাই ২০১৯

 সুষম খাদ্য-মানসম্মত ওষুধ মানুষের অধিকার

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে ‘খাদ্য’ একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা- যা জীবন ধারণের জন্য এর কোন বিকল্প নেই। আর সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সুখী-সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিশুদ্ধ খাদ্য আজ এতটাই কঠিন, এতটাই বিষযুক্ত করে ফেলছে কিছু অসাধু বিবেকহীন, ব্যক্তিগত মুনাফালোভী ব্যবসায়ী; যার ফলে আদালত পর্যন্ত ভেজাল খাদ্য আর নকল ওষুধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা চায়। ৫২টি খাদ্যপণ্য অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ সংবলিত হাইকোর্টের (১৩ মে, ২০১৯) পর্যবেক্ষণে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সরকার বিশেষ করে দেশের ক্ষমতাসীন দল এবং প্রধানমন্ত্রীকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করতে এবং প্রয়োজনে এই নির্দিষ্ট মহামারীর বিরুদ্ধে ‘জরুরী অবস্থা’ জারি করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের ছয় পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত আদেশে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, ‘কোন বিষয় কখন অগ্রাধিকার পাবে, সেটা অবশ্য সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়, আদালত সেটা ‘ডিক্টেট’ করতে পারেন না। কিন্তু আদালতের অভিমত এই যে- খাদ্যে ভেজালই সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত। আদালত এই পর্যায়ে ‘সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী যুদ্ধের মতোই ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার’ পক্ষে মত দিয়ে বলেন, ‘এই যুদ্ধের লক্ষ্য হবে- খাদ্য, খাওয়ার পানি ও ওষুধ ইত্যাদিতে ভেজাল দেয়া কিছুর উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ করা। একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি বড় শহরে ওয়াসা পাইপলাইন দিয়ে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। রিকশাচালকদের মতো সীমিত আয়ের মানুষেরা যাতে রাস্তার পাশের ওয়াসা ট্যাপ থেকে পানি পান করতে পারেন’। বিষযুক্ত বা ভেজাল খাদ্য নিয়ে ১৯৯৪ সালে আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি তাদের প্রতিবেদনে বলেন, ফরমালিনযুক্ত খাবার ‘ফুসফুস’ ও ‘গলবিল’ এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ‘গলবিল’ এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য এই ‘ফরমালিন’কে দায়ী করেন। পাশাপাশি টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানিয়ের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশের পর মানবদেহের এমন কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপিন্ড ও অস্থিমজ্জার। ধীরে ধীরে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। খাদ্যে ভেজালের কারণেই দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি, ফেলিউর হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি, চর্মরোগ এগুলো দিন-দিন বেড়েই চলেছে। যার কারণে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন পড়ে থাকে! পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হতে ৭০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ, লিভার আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার, চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখের মতো মানুষ। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভপাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো, পেট ব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথা ঘোরা, মল পাতলা বা হজম শক্তি কমে যাওয়া। শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যাওয়া। বিশেষজ্ঞেরে মতে, ইউরিয়া ও হাইড্রোজ পেটে গিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেপটিন এসিড তৈরি করে যা ক্ষুধামন্দা, খাবারে অরুচি, বৃহদান্ত ক্ষুদ্রান্তে প্রদাহসহ নানারকম শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে। মেটালবেইজস্ট ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গ-গোল, ডায়রিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলফুল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করা খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ফলমুল আকর্ষণীয় করে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ড্রাস্টিয়াল রং, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন এ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধ শিল্পের প্রসার-বিকাশ ঘটেছে, তা সত্যিই অভাবনীয় সাফল্য ও ইতিবাচক দিক। সম্প্রতিকালে গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ওষুধ শিল্পের প্রসার ও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ওষুধনীতি-২০১৬ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে- এটি আমাদের আশার কথা। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখা উচিত, ওষুধ হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ পৃথিবীর প্রায় ১৫০টি দেশে এখন রফতানি হচ্ছে। ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়- এই দিকের প্রতি আমাদের সবাইকে আন্তরিক ও সচেতন হতে হবে। কারণ, এক শ্রেণীর অসাধু অতি মুনাফালোভী চক্র রয়েছে যাদের কাজই হচ্ছে মানুষকে ঠকানো এবং এরাই নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি করে সরবরাহ করে থাকে। আর নকল ওষুধের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন ‘এ্যান্টিবায়েটিক’! সরকার ১০টি ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স ইতোমধ্যেই বাতিল করেছে এবং আরও ২৩টি কোম্পানির এ্যান্টিবায়েটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবুও কিছু কিছু কোম্পানি সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে মানহীন ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে জরুরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় একটি জরিপ চালায় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার। তাতে দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কিডনাসক এ্যান্টিবায়েটিক ও সীসার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অন্যদিকে, হাইকোর্টে জমা দেয়া তাদের এক প্রতিবেদনে বিএসটিআই জানায়, ১৪টি ব্র্যান্ডের ১৮টি পাস্তুরিত/ইউএইচটি দুধে আশঙ্কাজনক ও ক্ষতিকারক কিছু নেই। কিন্তু একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক সাহেব গবেষণা করে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন যে- পাস্তুরিত দুধের ৭টি নমুনার কোনটিতে কাক্সিক্ষত মাত্রার ‘সলিড নট ফ্যাট’ পাওয়া যায়নি। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দুধে ‘ফ্যাট ইন মিল্ক’ ৩.৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও এগুলোতে আছে ৩.৬ থেকে ৩.৬১ শতাংশ। এসব দুধে প্রচুর পরিমাণে এ্যান্টিবায়েটিক রয়েছে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পাস্তুরিত সব কটিতেই মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহারিত এ্যান্টিবায়েটিক লেভোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া রয়েছে ফরমালিন ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি। আমরা মনে করি, ১৮ কোটি মানুষের কথা চিন্তা করে সরকার এ ব্যাপারে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। মানসম্মত ওষুধ ও সুষমখাদ্য মানুষের অধিকার। খাদ্যে ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী এদেশের সুন্দর ও কর্মক্ষম জাতি গঠনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে আগামীর সোনালী ভবিষ্যতকে ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে করতে ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের উচিত, খাদ্যে ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×