ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য কেমন বাজেট চাই

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৭ মে ২০১৭

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য কেমন বাজেট চাই

সামনের অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সনাতনী প্রক্রিয়ার আলাপ-আলোচনা শেষ পর্যায়ে আছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে তথ্য প্রযুক্তি খাত এবার ভাগ্যবান যে, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও বেসিস অন্তত দুইবার এক সঙ্গে যৌথ বৈঠক করেছে। বেসিস একক ও দলগতভাবে কমপক্ষে দু’বার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এর বাইরেও দলগতভাবে বেসিস অন্তত ৩ বার বৈঠক করেছে। এবার তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও বেসিস সম্মিলিতভাবে একই প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে পেশ করেছে। অর্থমন্ত্রী নিজে গত ২ মে তার ১১তম সভাটি হোটেল সোনারগাঁও এ করেছেন। আমি নিজে বেসিসের পক্ষে আমাদের কথা বলতে পেরেছি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যত ধরনের সভা-সমাবেশ-মত বিনিময় ও আলাপ-আলোচনা করার তা করেছে। এমসিসিআই ও এফবিসিসিআইও যা যা করণীয় তা করেছে। মৌখিক বা লিখিত সকল প্রস্তাবনা এখন সরকারের কাছে রয়েছে। আরও কিছু আলোচনার আনুষ্ঠানিকতা হয়ত পালিত হবে। তবে নরম গরম পরিবেশে আমরা এখন কেবল বাজেট পেশ করার জন্য জুন মাসের দিনটির অপেক্ষায় রয়েছি। আমার জানা মতে, ১০ মে বাজেটের চূড়ান্ত খসড়া অর্থমন্ত্রীর কাছে যাবে। ১১ মে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে। এরপর সেটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সংসদে উত্থাপনের অপেক্ষায় থাকবে। আমরা এখন অপেক্ষায় রয়েছি এটি দেখার জন্য যে বাজেট পেশ করার পর আমরা কোন অবস্থায় পড়ব। যা হোক, পুরো বাজেট তো নয় আমি বরাবরের মতো এবারও তথ্যপ্রযুক্তি বাজেট নিয়েই সীমিত থাকব। এরই মাঝে এটি জানা গেছে যে, এবার সরকার ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেবে। এর মাঝে লক্ষাধিক কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটও থাকবে। বাজেটের আকারের প্রবৃদ্ধি আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিরই প্রকাশ মাত্র। ফলে উচ্চাভিলাসী বা বড় বাজেট আমাদের বড় স্বপ্নেরই প্রকাশ ঘটে। প্রাক-বাজেট আলোচনার শুরুতেই অতীতের দিকে তাকাই। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য ৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল অর্থ বাজেটে যা মোট বাজেটের ২.৪৪ শতাংশ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে বিদায়ী অর্থবছরে বাড়তি দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ পেয়েছিল এ খাতটি। অন্যদিকে আগের অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের জন্য ৬২২ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এই খাতে বিদায়ী বছরে আইসিটি ডিভিশনের জন্য এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার হয়েছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ২১০ কোটি টাকা। বিদায়ী বাজেটে টেলিকম খাতেও বরাদ্দ বেড়েছিল। বিদায়ী অর্থবছরের জন্য টেলিকম খাতের জন্য দুই হাজার ৫১২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ছিল দুই হাজার ১১৮ কোটি টাকা। আমি জানি না এবার এই অঙ্কটি কি হবে। আমাদের প্রত্যাশা যে, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও টেলিকম বিভাগের বাজেটে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ বাড়বে। অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের বরাদ্দ অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকায় যাবে সেটি আমার প্রত্যাশা। সফটওয়্যার, সেবা ও হার্ডওয়্যার রফতানিতে নগদ সহায়তা চাই : বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশাটি হচ্ছে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার রফতানিতে নগদ সহায়তার বিষয়টি। গত ২১ অক্টোবর ২০১৬ ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি এই দাবিটি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উত্থাপন করি। সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এটি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাই। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে শতকরা ১০ ভাগ সহায়তা প্রদানের ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই এই কথাগুলো বলা দরকার যে সফটওয়্যার ও সেবাখাত থেকে ১৮ সালে ১ বিলিয়ন ও ২১ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির টার্গেট রয়েছে। আমরা এরই মাঝে গত বছর ৭০০ মিলিয়ন ডলার রফতানি করেছি। ১৭ সালে এটি ১ বিলিয়ন অতিক্রম করবে। ৫ বিলিয়নের জন্য আমরা ২১ সাল নয় ২০ সালেই আমরা সীমাটা অতিক্রম করতে চাই। এটিও স্মরণ করা দরকার যে, তথ্যপ্রযুক্তির ৫ বিলিয়ন ডলার কার্যত বস্তুগত রফতানি খাতের ৫০ বিলিয়ন ডলারের সমান। কারণ, আমরা কোন বস্তু নয় মেধা রফতানি করি। একটি টিভি অনুষ্ঠানে আমি অর্থমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি যে, আমাদের ২৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে নগদ সহায়তা দেয়ার দরকার নেই। আবার গত ২ মে ১৭ হোটেল সোনারগাঁওয়ের এক অনুষ্ঠানে তিনি আমাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস প্রদান করেন। অন্যদিকে এটাও বলা দরকার যে, রফতানি খাতগুলো আয়কর রেয়াতের পাশাপাশি নগদ সহায়তা পেয়ে থাকে। আমরা সবিনয়ে এটি বলতে চাই যে, রফতানি খাতের সবাই কর অব্যাহতির পাশাপাশি নগদ সহায়তা পায়। আমরাও সেটি পেতে পারি। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর অনুকূল মনোভাবের পরও আমরা এই পাওনা থেকে বঞ্চিত হব সেটি আমি আশা করি না। ডিজিটাল পণ্যে শুল্ক ও ভ্যাট : বিদায়ী বাজেটে সব ধরনের কম্পিউটার এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আনুষঙ্গিক বিভিন্ন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক দুই শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে পাঁচ শতাংশ করা হয়। বিদায়ী বছরে মনিটর, ফাইবার অপটিক্স ক্যাবল ইত্যাদির শুল্ক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়। সবচেয়ে বড় বিষয়টি ছিল যে ইন্টারনেটের ব্যবহারের ওপর বিদ্যমান ভ্যাট ও শুল্কের সঙ্গে আরও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। ডিজিটাল পণ্য সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ধারণা স্পষ্ট করা দরকার। আমরা আমদানি পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুতকৃত হার্ডওয়্যার ও দেশে উৎপাতি হয় তেমন সফটওয়্যার পণ্যের শুল্ক ৫ ভাগ থেকে দশভাগ এবং ভ্যাট ১০ ভাগ আরোপ করাকে সমর্থন করি। এই ব্যবস্থার ফলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে। দেশের সক্ষমতা অর্জন রফতানিকেও সহায়তা করবে। সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে আমরা কেবল এই ছাড়টুকু দিতে পারি যে, আমরা যেসব সফটওয়্যার বানাতে পারি না যেমনÑ অপারেটিং সিস্টেম ও ডাটাবেজ সেগুলোকে শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত তালিকায় রাখা যেতে পারে। তবে বিদেশ থেকে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ ইত্যাদি ডিজিটাল যন্ত্রের যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানির ওপর কোন শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট চাই না। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুসারে আমরা দেশে ডিজিটাল পণ্য উৎপাদন করতে চাই। দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য এই ব্যবস্থাটি করতে হবে। দেশীয় পণ্যে কোন স্তরে কোন শুল্ক বা ভ্যাট দেয়া যাবে না এবং দেশীয় হার্ডওয়্যার শিল্পখাতকেও আয়করমুক্ত করতে হবে। যেসব এলাকাকে হাইটেক পার্ক ঘোষণা করা হয়েছে সেসব এলাকায় উৎপাদিত পণ্যকে রফতানির মতো দেশীয় বাজারের জন্যও একই সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। প্রসঙ্গত এটিও বলা দরকার যে ডিজিটাল ডিভাইসের খুচরা বিক্রির ওপর ভ্যাট আরোপ করা উচিত হবে না। এই ভ্যাট আমদানি স্তরেই আদায় করতে হবে। খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট দেশীয় শিল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ উভয় খাতকেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল পণ্যে শুল্ক ও খুচরা ভ্যাট : তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য খুচরা ভ্যাট এবারও সর্বোচ্চ উদ্বেগের বিষয়। বিদ্যমান শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের চাপে দেশে ইন্টারনেটের কানেকশন বাড়লেও প্রকৃত ব্যবহার বাড়েনি। ইন্টারনেট মানে এখন ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ ও ইমো। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ইন্টারনেটের বাড়তি মূল্য এর অন্যতম কারণ। ফলে এবারও আমরা ইন্টারনেট শুল্ক ও ভ্যাট মুক্ত করার দাবি জানাই। আমার কেন জানি মনে হয় রাজস্ব আহরণ করার সহজ উপায় হিসেবে টেলিকমকে কোন ছাড় দিতে আগ্রহী নয় এবং তারা ইন্টারনেট সভ্যতার মূল বিষয়টিই উপলব্ধি করতে চান না। এই উটপাখির প্রবণতা থেকে মুক্তি পাবার সম্ভাবনাকে তিরোহিত করে আমি ভ্যাট নিয়ে নতুন জটিলতার আশঙ্কা করছি। সামনের বছর ভ্যাট আইন বলবৎ হলে খুচরা পর্যায়ে ডিজিটাল ডিভাইস, সফটওয়্যার ও আইটি সেবার ওপরও যদি সকলের মতোই ভ্যাট আরোপ করা হয় তবে একটি বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টি হবে। নতুন আইনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলা হয়নি। ফলে একটি চরম জটিল অবস্থার দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। আমি নিজে মনে করি নতুন ভ্যাট আইন কেবল তথ্যপ্রযুক্তি খাত নয় সকল ব্যবসার ক্ষেত্রেই মারাত্মক সঙ্কট তৈরি করবে। বাজেট পেশ করার আগে আমার কাছে এটি একটি বড় সঙ্কট বলে মনে হচ্ছে। ইংরেজী নির্ভর ভ্যাট অনলাইন সফটওয়্যার দিয়ে প্রশিক্ষণবিহীন রাজস্ব কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে চরম জটিলতা তৈরি হতে পারে। এখন পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থমন্ত্রীকে এই বিষয়ে যতটা অনড় দেখা যাচ্ছে তাতে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আতঙ্ক নিয়েই বাজেটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পক্ষ থেকেও সেই আশঙ্কায় আছি। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প সম্পর্কে দুটি কথা বলা দরকার। এই প্রকল্পে এখনও বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের মুদি দোকানদার থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ীদের জন্য যদি কেবল ইংরেজী ব্যবহার করে তবে কাজটি আত্মঘাতী হবে। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা কেবল অনলাইন সফটওয়্যার পেলেই সেটিকে বলবৎ করতে পারবে সেটি মনে করার কোন কারণ নেই। এনবিআর এর কর্মকর্তা নিজেরা ডিজিটাল না হলে ভ্যাট বা ট্যাক্স কোনটাই ডিজিটাল হবে না। ২৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহতি : আমরা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি যে সরকার আমাদের সফটওয়্যার ও সেবাখাতকে ২৪ সাল অবধি কর অব্যাহতি দিয়েছেন। এই অব্যাহতিতেও শুভঙ্করের ফাঁক আছে। প্রচুর আইটি সেবা খাত আছে তবে সেবা খাতের প্রায় দেড় ডজন খাত আছে যা আইটিএনেবল সংজ্ঞায় নেই। অন্যদিকে কর অব্যাহতির সুবিধা নেয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে সময় ও অর্থ ব্যয় করতে আমরা যে দশায় পৌঁছেছি তা বর্ণনাতীত। আমরা এনবিআরের এই সার্টিফিকেট প্রথাটি বাতিল করার জন্য অনুরোধ করি। ঢাকা, ৫ মে, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ : www.bijoyekushe.net
×