ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেহাল উচ্চশিক্ষা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৬ মার্চ ২০১৭

বেহাল উচ্চশিক্ষা

উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা যে বেহাল, সে কথা নতুন করে বলার দরকার হয় না। শিক্ষাকে হালে ফিরিয়ে আনার জন্য অজস্র বাক্য ব্যয় করা হচ্ছে এখনও, কিন্তু লাইনচ্যুত ট্রেনের বগিকে আর লাইনে ফেরানো হচ্ছে না। জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষা প্রবর্তনের কথা যে আসলে গালগল্প এবং চর্বিত চর্বণ উচ্চারণ, তা সর্বজনবিদিত। মানসম্পন্ন শিক্ষার স্লোগান নিয়ে শিক্ষিতজনদের যে সম্মেলন হয়, তাতে কতশত সুপরামর্শ যে নির্গলিত হয়, তার ইয়ত্তা নেই। সেসব পরামর্শ কাজে লাগোনার উদ্যোগ আর নেয়া হয় না। শিক্ষাব্যবস্থার যে চিত্র প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত, সর্বত্রই এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ। পরীক্ষার ফলাফলে পাসের অত্যধিক হার দেখে মনে হতে বাধ্য যে, সুনসান শিক্ষাব্যবস্থার নহর বয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে। শিক্ষাদান সমস্যামুক্ত, কোন সঙ্কট নেই বলেই বেশ ভালভাবে পড়াশোনা হচ্ছে, তাই পাসের হার বাড়ছে। আসলে যে সবটাই ফাঁপা এবং চতুরতায় আকীর্ণ তা স্পষ্ট হতে দেরি হয় না। ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর যে করুণ দশা দৃশ্যমান হয়ে আসছে, তাতে শিক্ষা খাতের গলদগুলো এমনভাবে প্রকট হয় যে, বায়বীয় এক শিক্ষা পদ্ধতির কবলে পড়ে শিক্ষার্থীরা ফানুসে পরিণত হতে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হলেও সেসব সমস্যার অধিকাংশেরই সমাধান আর হয় না। গোঁজামিল দেয়া ব্যবস্থায় যে শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত আর হয় না, সে কথা উপলব্ধি করার বোধ শক্তিটুকুও সম্ভবত নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বরং তারা শিক্ষা বাণিজ্যের বিস্তারকে ভালবেসে যত রকম ও ধরনের বাণিজ্যিকীকরণ করা যায়, তাতেই নিবদ্ধ এবং নিমগ্ন তারা। কে তাদের বলবে, পথ এটা নয়। বরং তাদের বদ্ধমূল ধারণা, এটাই পথ ও পদ্ধতি। শিক্ষা এখন আর অধিকার নয়, বরং পরিণত হয়েছে বিনিয়োগে। শিক্ষক ও অবকাঠামো সঙ্কটসহ একান্ত সমস্যায় জর্জরিত দেশের সরকারী কলেজ। দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগুলো বিরাজ করলেও তা সমাধানে কার্যকর তেমন উদ্যোগ নেই। ফলে এসব কলেজে মানসম্মত শিক্ষা দারুণভাবে বিঘিœত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট। কলেজগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষক সঙ্কট। কোর্স, বিভাগ এবং ডিগ্রী ও শিক্ষার্থীর তুলনায় প্রয়োজনীয় শিক্ষকের পদও সৃষ্টি হয়নি। সারাদেশে সরকারী কলেজগুলোতে একজনও শিক্ষক নেই এমন বিভাগের সংখ্যা শতাধিক। অধিকাংশ কলেজে নিয়মিত ক্লাস হয় না। ফলে সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষা নেয়া হয়। ইনকোর্স টার্ম পেপার ও মৌখিক পরীক্ষায় অকাতরে নম্বর বিলিয়ে দেয়া হয়। অনেক কলেজে পরীক্ষার্থীরা ফ্রি স্টাইলে নকল করে। শিক্ষা নিয়ে এমন বেহাল দশা তৈরি হলেও একাডেমিক উন্নয়নে কলেজ প্রশাসনের উদ্যোগ কম। শিক্ষকদের পাঠদানে আগ্রহী করা বা জবাবদিহিতার উদ্যোগ নেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছে একজন শিক্ষকের বিপরীতে তিনজন শিক্ষার্থী। কিন্তু বাস্তবতা সেই নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ছাড়া চলছে অর্ধশত সরকারী কলেজ। আবার অবকাঠামো, শ্রেণীকক্ষ ও বেঞ্চ সঙ্কট প্রকট। নেই বিজ্ঞানাগার ও পাঠাগার। মূলত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য চলছে বলেই শিক্ষা ক্ষেত্রের সর্বত্র বিশৃঙ্খলতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অরাজকতার জোয়ার বইছে। ভাল শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব জাতির ভবিষ্যতের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হলেও কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে নির্বিকার। সুলভে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত না হলে মেধাবী ও মানসম্পন্ন জাতি গঠন বাধাগ্রস্ত হয়ে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা মূল্যবোধ, মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ ও পরিবেশ রক্ষা করে শিক্ষাকে জাতির মেরুদ-তুল্য করা। নৈরাজ্য, অরাজকতামুক্ত হোক শিক্ষাদান ও শিক্ষাব্যবস্থা পুরো জাতির তা-ই প্রত্যাশা।
×