ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘খালেদা জিয়া বার্ন ইউনিট’ উদ্বোধন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৩ মার্চ ২০১৬

‘খালেদা জিয়া বার্ন ইউনিট’ উদ্বোধন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -স্বদেশ রায়

আমির আলী প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আসলে কি তিনি টিভি চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজ ঠিক দেখছেন? চশমার কাঁচ দুটো কয়েকবার ভাল করে মুছে নিলেন। কিন্তু তারপরেও তো একই নিউজ তিনি দেখতে পাচ্ছেন স্ক্রলে। একেবারে স্পষ্ট লেখা- আর কিছুক্ষণের ভিতর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছাবেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং মেডিক্যালের ডিজি অপেক্ষা করছেন। না, এখন আর শুধু স্ক্রলের ব্রেকিং নিউজে নেই। এখন প্রত্যেকটা চ্যানেলের মূল নিউজে চলে গেছে। টিভি এ্যাঙ্কররা, এখন দারুণ তৎপর। সকলেই নিজ নিজ চ্যানেলের প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করছেন, ‘এই মুহূর্তে আপনি সেখানে কী দেখতে পাচ্ছেন?’ তারাও মহাউত্তেজনার সঙ্গে সমস্ত শরীর নাড়িয়ে হাতে মাইক্রোফোন থাকা সত্ত্বেও একেবারে ষাটের দশকের পল্টনের গলায় বলেছেন। ‘চারপাশে গভীর উৎসুক মানুষ অপেক্ষা করছে, কখন প্রধানমন্ত্রী আসবেন। আমরা আশা করছি আর কিছুক্ষণের ভিতর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পৌঁছে যাবেন। কারণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবের নিরাপত্তা বেষ্টনীও বেশ জোরদার করা হয়েছে।’ আমির আলী এবার নড়েচড়ে টেলিভিশন পর্দার দিকে তাকালেন। হাতের রিমোটটি যত দ্রুত পারা যায় অত দ্রুতই ব্যবহার করে গোটা বিশেক চ্যানেল ঘুরে এলেন। সবখানেই একই অবস্থা। তবে তাঁর চোখ আটকে গেল জনপ্রিয় একটি চ্যানেলে। তিনি খুশিও হলেন। বড়ই করিৎকর্মা এই চ্যানেলটি! ইতোমধ্যে দুজন বিশেষজ্ঞ তারা জোগাড় করে ফেলেছেন। আমির আলী এবার বেশ গ্যাট হয়ে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, না এদের কথা না শুনে আর অন্য চ্যানেলে যাব না, তাই যত ভাল সিরিয়াল থাকুক না কেন। বিশেষজ্ঞ ড. মহিমউল্লাহকে এ্যাঙ্কর প্রশ্ন করলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটটি বেগম খালেদা জিয়ার নামে নামকরণ করে উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন- এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?’ ড. মহিমউল্লাহ সোজা হয়ে বসে বলতে শুরু করলেন- ‘দেখুন ইতিহাসের সত্য যাতে মানুষ খুঁজে পায়, প্রতিটি সরকারের উচিত সেই কাজ করা। খালেদা জিয়া শত শত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছেন, অতএব তার নামেই বার্ন ইউনিট হওয়া উচিত। কারণ একজন মানুষ যখন শতবর্ষ পরে ওখানে যাবেন তখনও তিনি জানতে পারবেন, ইতিহাসের ওই জঘন্যতম ঘটনা। আমি মনে করি সরকারের উচিত হবে পাশাপাশি আরেকটি ফলকে খালেদার কৃতকর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখে রাখা। যেমন ভিয়েতনামের অনেক গণকবরের পাশে লেখা আছে।’ এবার ড. উল্লাহ আরও একটু উত্তেজিত। তিনি বলতে শুরু করলেন ‘আমি এই সুযোগে আরও বলতে চাই আমাদের দেশে একাত্তর সালের যে গণকবরগুলো আছে তার নামকরণও একইভাবে হওয়া উচিত, ইয়াহিয়া গণকবর, ভুট্টো গণকবর, টিক্কাখান গণকবর, নিয়াজী গণকবর, গোলাম আযম গণকবর... এবার এ্যাঙ্কর খুবই ব্যস্ত একেবারে ড. উল্লাহর মুখের দিকে হাত নিয়ে বললেন, ‘আপনাকে একটু থামাতে হচ্ছে, আমরা একটু বিশিষ্ট গবেষক ও কবি জুলহাস ফজহারের বক্তব্য শুনতে চাই। আচ্ছা, মি. ফজহার আপনি প্রধানমন্ত্রীর এ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?’ মি. ফজহার একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ‘এটা তো একেবারেই পরিষ্কার একটি বিষয়, এটা সম্পূর্ণরূপে একটি ভারতীয় চক্রান্ত। শেখ হাসিনা ভারতের তাঁবেদার সরকার। তাই তিনি ভারতের কথামতো এ কাজ করছেন। মানুষ পোড়ানোর জন্যে যদি কারও নামে বার্ন ইউনিট করতে হয়, তাহলে তো ভারতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের নামে বার্ন ইউনিট করতে হবে। কারণ, সেখানে হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন পোড়ানো হচ্ছে।’...শশব্যস্ত এ্যাঙ্কর বললেন, ‘মি. ফজহার ভারতে কিন্তু মৃত মানুষ অর্থাৎ শবদেহ পোড়ানো হয়।’ ফজহার- ‘দেখুন মানুষ মানুষই। তার শেষ বিচার না হওয়া অবধি জীবিত ও মৃতের ভিতর কোন পার্থক্য নেই। তাই জীবিত মানুষ পোড়ানো যা মৃত মানুষ পোড়ানোও তাই। তাই ভারতে যদি মানুষ পুড়িয়ে অপরাধ না হয় তাহলে এখানে খালেদা জিয়ারও কোন অপরাধ নেই। তাছাড়া আমার বন্ধু ড. উল্লা এর ভিতর কেন একাত্তরকে টেনে আনলেন। এটাই বর্তমান সরকারের ও তাদের লোকদের সব থেকে বড় সমস্যা। তারা কথায় কথায় একাত্তরকে টেনে আনেন। একাত্তরকে টেনে এনে উনি খালেদা জিয়া সম্পর্কে কী ইঙ্গিত করতে চান? জেনে রাখবেন, খালেদা জিয়া একাত্তর সালে ক্যান্টনমেন্টে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীও স্বেচ্ছাবন্দিত্ব গ্রহণ করতেন’... এ্যাঙ্কর : ‘আমরা একটু খবরে চলে যাচ্ছি, খবরের পরেই আবার আপনাদের মতামত শুনব।’ অসময়ে খবর। আমির আলীর চোখ কান আরও বেশি উদগ্রীব। সংবাদ পাঠিকা সংবাদ শুরু করলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে খালেদা জিয়ার নামে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন এ কাজকে স্বাগত জানিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ডিপ্লোম্যাটদের ক্লাব ‘টিউসডে ক্লাব’ একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তারা তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছেন, পশ্চিমা দেশগুলো সব সময়ই এ ধরনের গণতান্ত্রিক সহাবস্থান পছন্দ করে। তারা নিজ দেশেও এটা পালন ও লালন করে। আজ বাংলাদেশ যে সে পথে যাচ্ছে সেজন্য তারা আনন্দিত। বিশেষ করে তারা বেগম জিয়াকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন, তার জীবন্ত মানুষ পোড়ানোর মতো এই শক্ত অবস্থান নেবার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ যে সহাবস্থানের গণতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারল- এটা গণতন্ত্রের ইতিহাসে অনেক বড় ঘটনা। পশ্চিমা বিশ্ব এ মুহূর্তে অন্তত নিজ দেশে না পারুক মধ্যপ্রাচ্যে খালেদা জিয়ার এ পথ অনুসরণ করবে যাতে সেখানে সহাবস্থানের গণতন্ত্র প্রস্ফুটিত হয়।’ এবার একটু আমির আলীর মাথাটা ঘুরে গেল। তিনি পশ্চিমা বিশ্বের এই বিবৃতি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। মানুষ পোড়ানো, গণতান্ত্রিক সহাবস্থান, মধ্যপ্রাচ্য...না কেমন একটু তাল গোল পাকানো। তবে এ নিয়ে ভাবনার বেশি সময় পেলেন না আমির আলী। কারণ ইতোমধ্যে সংবাদের পরবর্তী অংশ চলে এসেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠান ‘কু জন’ ‘ছিঃ আই বি’ সুশীল সমাজের অন্যতম মণি সেনাপ্রিয় শর্মা, প্রত্যেকেই বিবৃতি দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা খালেদার এই অমর কীর্তির জন্যে তাঁকে যাতে প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানান এবং অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে সংলাপে বসেন সেজন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। আমির আলী আর বেশিক্ষণ টিভি পর্দায় চোখ রাখতে পারছেন না। তার কাছে বিষয়গুলো বড়ই গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। এ তো বাংলা সিনেমার ত্রিভুজ প্রেম নয়, একেবারে পরশুরামের সেই হারিত জারিত চক্রাকার প্রেম। এ চক্রে ঢোকা মুস্কিল। ঘটনা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছেন না আমির আলী। এমন সময় অনেকটা হন্তদন্ত হয়ে তাঁর ছেলে ঘরে ঢোকে। হাতে পাতলা দুটো সংবাদপত্র মোড়ানো। আমির আলী তার হাতের দিকে তাকিয়ে বলেন, কিরে তোর হাতে ও কী? তার ছেলে বললে, আব্বা দেখনি এখনও? একটা ইংরেজী ও একটা বাংলা কাগজ প্রধানমন্ত্রীর এই বার্ন ইউনিট উদ্বোধন উপলক্ষে টেলিগ্রাম বের করেছে বিশেষ সম্পাদকীয়সহ। দুটি কাগজেরই বিশেষ সম্পাদকীয়র শিরোনাম একই... ‘রাজনৈতিক সহাবস্থান’। তারপরেই ফলাও করে কাজী ঘুষহার নিউজ। কাজী ঘুষহা আজ তাঁর দরবারের একটি বারান্দা উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আজ আমার দরবারের লোকদের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আপনারা সব সময় খুনী এবং মানুষের ভিতর প্রভেদের সীমারেখা টেনে (শিট ডাউন, গোলমাল করবেন না) দরবারে হইচই করেন। আসলে আজ থেকে- ওই যে এক বাঙালী কবি কী যেন লাইনটা... যাহোক পুরো মনে নেই তার অনুকরণে বলতে চাই, আমার চক্ষে মানুষ ও খুনীতে কোন ভেদাভেদ নেই।’ টেলিগ্রামের পাতা থেকে মুখ তুলে আমির আলী আবার টেলিভিশন পর্দার দিকে তাকালেন, দেখতে পাচ্ছেন র‌্যাব ও পুলিশ বেষ্টনীর সামনে দাঁড়িয়ে রিপোর্টার মাইক্রোফোন হাতে বলে চলেছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই... পিংক ফয়েডের মেটাল রিংটোনটি বড়ই উচ্চৈঃস্বরের। বালিশের পাশেই সেল ফোনটি বেজে উঠতেই সব কিছু কেমন হয়ে গেলো। বালিশে কাৎ হয়ে- চোখ কচলে ফোন ধরলেন আমির আলী। [email protected]
×