
বোয়িং আতঙ্ক দেশ-বিদেশে
ভারতের আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার (৭৮৭) ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর আবারও বোয়িং প্লেনের সেফটি ও কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বার বার কেন বোয়িং নির্মিত প্লেন এ ধরনের মারাত্মক দুঘটনায় পতিত হচ্ছে- সেটা ভাবিয়ে তুলেছে মার্কিন এই কোম্পানিকে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, ড্রিমলাইনার এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে- এমন আশঙ্কা সম্পর্কে খোলামেলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বোয়িংয়ের এক সাবেক বিশেষজ্ঞ। তার মতে-পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব ড্রিমলাইনার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা করতে হবে। তার এহেন বি্েস্ফারক মন্তব্যে এখন চলছে তোলপাড়।
তার মতো আরও কজন বিশেষজ্ঞ বোয়িং কোম্পানির প্লেনের সেফটি ও কোয়ালিটি নিয়ে জোরালো প্রশ্ম তুলেছেন। বোমা ফাটাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এতে দেশ বিদেশে দেখা দিয়েছে বোয়িং আতঙ্ক।
সঙ্গতকারণেই এখন বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে ড্রিমলাইনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তাতে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। বিমান এয়ারলাইন্সে থাকা ছয়টি ড্রিমলাইনারই গত কদিনে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বলে দৈনিক জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন এমডি ড. সাফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়েনি। স্বাভাবিকভাবেই এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এ সংক্রান্ত কোনো দিকনির্দেশনা যদি বোয়িং থেকে আসে তখন দেখা যাবে কি করণীয়।
উল্লেখ্য, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার হলো দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট মাঝারি আকারের সুপরিসর উড়োজাহাজ। ২০১১ সালে এই সিরিজের বিমান প্রথম বাজারে আনে বোয়িং। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ড্রিমলাইনার সিরিজের ১ হাজার ১শ’রও বেশি উড়োজাহাজ যাত্রী পরিষেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে এই সিরিজের ৬টি উড়োজাহাজ রয়েছে। উড়োজাহাজগুলোর স্থানীয় ব্র্যান্ডনেম হচ্ছে- আকাশবীণা, গাঙচিল, সোনার তরী, হংস বলাকা, রাজহংস এবং অচিন পাখি।
এ ছাড়াও রয়েছে- আরও চারটি ৭৭৭-৩০০ ইআর। এর মধ্যে বছর দুয়েক আগে একটি ড্রিমলাইনারের উইন্ডশিল্ড ফেটে যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় চলে। বিমানবহরে যুক্ত হবার মাত্র চার বছরের মাথায় এভাবে উ্ইন্ডশিল্ড ফেটে যাওয়াটাকে অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক বলে মতামত দিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। তখন বিমানও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে।
এর আগে বিমানের একটি ৭৭৭ প্লেনে ত্রুটি দেওয়ায় মাসের পর মাস ইতালিতে সার্ভিস নেওয়ার জন্য পাঠানো হলেও সেখানে মাসের পর মাস পড়ে থাকায় বিমানকে চরম খেসারত দিতে হয়েছে। বোয়িংয়ের কাছ থেকে চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বিক্রয়োত্তর সেবা না পেয়ে বিমান মুখ ফিরিয়ে এয়ারবাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিমান এখনো এয়ারবাস কেনার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে বিমান সদর দপ্তরে এয়ারবাসের স্থানীয় কর্মকর্তা রাফায়েলকে এ নিয়ে বৈঠক করতে দেখা গেছে।
এদিকে গুজরাটে দুর্ঘটনার তিনদিন পর এয়ারইন্ডিয়ার আরও একটি ড্রিমলাইনারে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। সান ফ্রান্সিসকো থেকে মুম্বাইয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়া ওই ফ্লাইট মাঝপথে যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়ে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় নির্ধারিত যাত্রাবিরতির সময় যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। সান ফ্রান্সিসকো থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাই যাচ্ছিল এই প্লেন। কিন্তু কলকাতার কাছে এসেই ধরা পড়ে যান্ত্রিক ত্রুটি। এর এক ইঞ্জিনে ত্রুটি ধরা পড়ে। ফলে সেটি দ্রুত অবতরণ করে কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
তার একদিন আগেই হংকং থেকে দিল্লিগামী এয়ার ইন্ডিয়ার অপর একটি ড্রিমলাইনার মাঝ আকাশ থেকে ফিরে আসে সন্দেহভাজন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে। এর আগেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেন্নাইগামী ফ্লাইট (বিএ৩৫) লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার দ্বারা পরিচালিত ওই বিমানটি প্রায় দুই ঘণ্টা আকাশে থাকার পর ফেরত আসে।
এই ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি বড় আকারের বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনার পর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।্ এ ধরনের কয়েকটি ঘটনায় দেশটির সিভিল এভিয়েশন মহাপরিদপ্তর (ডিজিসিএ) এয়ার ইন্ডিয়াকে তার সব বোয়িং বিমানগুলিতে অতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে।
এসব ঘটনার আলোকে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী গোটা বোয়িং প্লেনের সেফটি এন্ড কোয়ালিটি (নিরাপত্তা ও গুণমান) নিয়ে বেশ জোরেশোরে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ পাচ্ছে। এসব প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, এ যাবত বিশ্বব্যাপী দুর্ঘটনার শিকার হওয়া প্লেনগুলো বেশিরভাগই বোয়িং কোম্পানির।
আর শুধু ভারতেই গত ১০ বছরে দুটি বড় বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং দুটিতেই বোয়িং প্লেন ছিল। যেমন- আগস্ট ২০২০ সালে কেরালার কোঝিকোড়রে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৩৭- বিমান বিধ্বস্ত হয়। তারপর চলতি মাসে আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনার শিকার হয়। সেখানকার সর্দার বল্লভ ভাই পটেল বিমানবন্দর থেকে ওড়ার মাত্র ৫ মিনিট পরেই ভেঙে পড়ে ও আগুনের গোলায় পরিণত হয়।
এই দুর্ঘটনার পর বোয়িং বিমানের নিরাপত্তা প্রশ্নটি আবারও সামনে আসে। ওই দুর্ঘটনার সূত্র ধরে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়- বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে যতগুলো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় অর্ধেকই বোয়িং প্লেনে। আর শুধু ভারতেই, গত দশ বছরে দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং দুটিতেই ব্যবহৃত বিমান ছিল বোয়িং-এর।
এ অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে যে, বোয়িং একসময় সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নিরাপদ বিমান হিসেবে পরিচিত ছিল থাকলেও এখন কেন এত সন্দেহ ও প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে? কেন বোয়িং বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে এত প্রশ্ন উঠছে? এর পেছনে কি নির্মাণগত ত্রুটি, নক্সার ভুল, নাকি কোম্পানির গাফিলতি? আর কেনই বা ড্রিমলাইনার নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন সাবেক কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার স্যাম সালেহপৌর।
তার মন্তব্যের পর বিপাকে পড়েছে খোদ বোয়িং কোম্পানি, যার পথচলা শুরু হয় ১৯১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহরে। এটি এখনো বিশ্বের বৃহত্তম বিমান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। ১৬২ বিলিয়ন ডলারের নেটওয়ার্ক বোয়িং কোম্পানির। দুনিয়াজুড়ে এত শৌর্যবীর্য ও সুনামের পর এখন তারা দুর্ঘটনার জন্য কুখ্যাত হয় উঠেছে। আমেরিকার সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোয়িং-এর ১০৮ বছরের ইতিহাসে ৬০০০-টিরও বেশি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সব দুর্ঘটনায় ৯০০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, বোয়িং প্লেনের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত ত্রুটি আগে থেকেই আলোচনার বিষয় ছিল। কখনো বিমানের ব্যাটারিতে সমস্যা ধরা পড়েছে, আবার কখনো আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় দরজা খুলে যাওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালে বোয়িং ড্রিমলাইনারে ব্যাটারির সমস্যা দেখা দেয়। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ায় জাপানের দুটি বিমানে আগুন ধরে যায়। এই ঘটনার পর, বোয়িং ড্রিমলাইনারকে তিন মাসের জন্য উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়।
২০১৩ সালেই, লন্ডনের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বোয়িং বিমানে আগুন ধরে যায়। তখন কারণ হিসেবে শর্ট সার্কিট-কে দায়ী করা হয়। ২০২১ সালে তদন্তে দেখা যায় যে, বোয়িং ড্রিমলাইনারের ১০০-র বেশি বিমানে বৈদ্যুতিক সিস্টেমে ত্রুটি রয়েছে। এই ত্রুটির কারণে ওইসব বিমানকে গ্রাউন্ডেড, অর্থাৎ চলাচলের বাইরে রাখা হয়।
২০২৪ সালে সিডনি থেকে অকল্যান্ড যাওয়ার পথে একটি বোয়িং প্লেন মাঝআকাশে কেঁপে উঠেছিল। ঠিক একই বছরে সান ফ্রান্সিসকো যাওয়া একটি বোয়ি প্লেনের উইন্ডস্ক্রিন মাঝআকাশে ফেটে যায়। ২০২৪ সালেই আলাস্কা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে উড়ানের সময় বোয়িং বিমানের একটি দরজা ভেঙে পড়ে। এই ঘটনায় বোয়িংকে ১৬০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। এতেই শেষ নয়- ওই কোম্পানির প্লেনের বিরুদ্ধে আগুন লাগার সতর্কতা, উইন্ডস্ক্রিনে ফাটল, এমনকি ল্যান্ডিং গিয়ার আটকে যাওয়ার মতো বহু অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সদর দপ্তর শিয়াটলে এ সংক্রান্ত্র চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
ড্রিমলাইনারের আগে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি দেখা দেয়- বোয়িং-এর ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের প্লেনে ্একের পর এক দুর্ঘটনায়। বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনার পর এসবের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এতে ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম এবং সেন্সর নিয়ে প্রশ্ন উঠে। অন্যান্য বোয়িং মডেলের প্লেনেও মাঝে মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করে, তবে সেগুলো ৭৩৭ ম্যাক্স বা ৭৮৭ এর মতো গুরুতর নয়।
এর আগেও রেকর্ডসংখ্যক দুর্ঘটনায় পড়ার রেকর্ড আছে বোয়িংয়ের প্লেনের। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে উড্ডয়নের পর মাত্র ১৩ মিনিটে লায়ন এয়ারের ফ্লাইট ৬১০ সমুদ্রে বিধ্বস্ত হয়। ২০১৮ সালে সংঘটিত এই দুর্ঘটনায় ৮৯ জন নিহত হন। তদন্তে দেখা যায়, উড়োজাহাজের অ্যান্টি-স্টল সিস্টেম (এমসিএএস) ভুলভাবে সক্রিয় হয়ে গিয়েছিল, যা উড়োজাহাজটিকে নিচের দিকে টেনে নেয়।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৩০২ ইথিওপিয়া থেকে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি যাওয়ার পথে উড্ডয়নের ৬ মিনিট পর বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৫৭ জন নিহত হন। এই দুর্ঘটনার কারণও ছিল একই এমসিএএস সফটওয়্যারের ত্রুটি। এই দুটি দুর্ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের সব উড়োজাহাজ গ্রাউ এবং প্যান অ্যামের দুটি বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজের সংঘর্ষ ঘটে। এতে ৫৮৩ জন নিহত হন। এই দুর্ঘটনা আকাশপথে নিরাপত্তায় নতুন প্রটোকল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এরপর ১৯৮৫ সালে জাপান এয়ারলাইনসের দুর্ঘটনায় পতিত ফ্লাইট ১২৩ উড়োজাহাজটিও ছিল বোয়িং ৭৪৭ এসআর মডেলের। দুর্ঘটনায় পতিত উড়োজাহাজটি টোকিও থেকে ওসাকার দিকে যাওয়ার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পর্বতে পতিত হয়। এতে ৫২০ জন নিহত হন। উড়োজাহাজের টেইল সেকশনে আগের মেরামত সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এটি এখনো একক বিমান দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে ভারত মহাসাগরে নিখোঁজ হওয়া মালয়েশিয়া এয়ারের ফ্লাইটে। কুয়ালালামপুর থেকে বেজিং যাওয়ার পথে বোয়িংয়ের ৭৭৭ ইআর মডেলের ওই উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হয়। দীর্ঘদিন পর উড়োজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ ভারত মহাসাগরে পাওয়া যায়। তবে এটি কীভাবে নিখোঁজ হলো তা আজও রহস্য। এর বাইরে- ২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুর যাওয়ার সময় পূর্ব ইউক্রেনের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় বোয়িংয়ের একটি উড়োজাহাজ। এতে ২৯৮ জন নিহত হন।
আরও আলোচিত ঘটে নাইন ইলেভেনের সময় অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগনে হামলার ঘটনায়ও সন্ত্রাসীরা বোয়িং ৭৫৭ এবং ৭৬৭ মডেলের উড়োজাহাজ ব্যবহার করেছিল। এই ঘটনায় ২ হাজার ৯৭৭ জন নিহত হন। এই ঘটনা বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ নিরাপত্তায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। ২০০০ সালে ফিলিপিন্সের একটি বোয়িং ৭৩৭-২০০ উড়োজাহাজ খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৩১ জন নিহত হন।
২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোয়িং ৭৭৭ মডেলের একটি উড়োজাহাজ অবতরণের সময় আঘাত পায়। এতে তিনজন নিহত হন এবং ১৮০ জন আহত হন। এ ধরনের ত্রুটিজনিত দুর্ঘটনার পর বছর কয়েক আগে বোয়িংয়ের ইঞ্জিনিয়ার জোশুয়া ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের নির্মাণজনিত ত্রুটি তুলে ধরেছিলেন। এরপর তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ২০২৪ সালে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে তাবত দুনিযায় হৈচৈ পড়ে যা।
আরও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়- ২০১৯ সালে, বোয়িং-এর কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার ডন বারনেটের মন্তব্যে। তিনি ৭৮৭ ড্রিমলাইনারে ত্রুটি থাকার কথা প্রকাশ্যে আনেন এবং বোয়িং-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ২০২৪ সালে তিনিও মারা যান। বোয়িং-এর শুধু যাত্রীবাহী বিমানে নয়, সামরিক (মিলিটারি) বিমানেত্রুটি ধরা পড়েছে। বোয়িংয়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় পর পর দুজন প্রকৌশলীর রহস্যজনক মৃৃত্যুতেও অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয়।
এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ উঠলেও, বোয়িং কোম্পানি একটার পর একটা অর্ডার পেতে থাকছে। অর্ডারে তাদের কোনো ঘাটতি হয়নি। বরং ২০২৫ সাল বোয়িং কোম্পানির জন্য সবচেয়ে লাভজনক বছর হয়েছে। এই বছরে ৫১২টি বোয়িং বিমানের অর্ডার এসেছে, যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি এয়ারবাসের দ্বিগুণ।
সবচেয়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গত সপ্তাহে গুজরাটে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিধ্বস্ত হওয়ার আগে বোয়িংয়ের একজন ইঞ্জিনিয়ারের আশঙ্কা প্রকাশ নিয়ে। ড্রিমলাইনার সিরিজের সব বিমান নিয়ে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার স্যাম সালেহপৌর। গত বছরের এপ্রিলে তিনি দাবি করেছিলেন- বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের সব বিমানে গুরুতর যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে।
ওই সিরিজের সব বিমান গ্রাউন্ডেড করে ত্রুটি সারানোর পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বোয়িংকে ত্রুটি সারানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে স্যাম সালেহপৌর বলেছিলেন, খরচ বাঁচানোর জন্য বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের বিমানগুলো প্রস্তুতের ক্ষেত্রে যে প্রযুক্তি অবলম্বন করেছে কোম্পানি, তা ত্রুটিযুক্ত।
সিরিজের বিমানগুলোর যন্ত্রাংশ বা ফিউসেলেজগুলোর সন্নিবেশন ঠিকমতো হয়নি। প্রতিটি ফিউসেলেজ জয়েন্টের মধ্যে সামান্য ফাঁক রয়ে গেছে। আপাতভাবে ছোটো মনে হলেও এটি বেশ গুরুতর একটি ত্রুটি। কারণ প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিমস না থাকার কারণে অপারেশনের সময় বিমানের ফিউসেলেজগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, দুর্ঘটনার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি উড়োজাহাজের জীবনকালও (লাইফস্প্যান) কমিয়ে দিচ্ছে।
তখন তিনি জানান-স্বাভাবিক গতিতে বিমান চালানো হলে এই ত্রুটি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না; কিন্তু যদি গতি বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে বায়ুচাপ এবং বিমানের ইঞ্জিনের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার ক্ষেত্রে ফিউসেলেজ জয়েন্টগুলো ব্যর্থ হবে এবং তার পরিণতি হবে গুরুতর। এমনকি এ ধরনের পরিস্থিতিতে মাঝ আকাশে বিমান ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের যতগুলো উড়োজাহাজ অপরেশনে রয়েছে, সবগুলো পরীক্ষা করা হোক এবং জরুরি ভিত্তিতে ত্রুটি সারানো হোক।
সালেপৌর জানান, ড্রিমালাইনার সিরিজের বিমানগুলো প্রস্তুতের সময় এই ত্রুটি সম্পর্কে তিনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। এটি সারানোর সুপারিশও করেছিলেন।। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাতে আমল না দিয়ে প্রথমে স্যাম সালেহপৌরকে ড্রিমলাইনার প্রকল্প থেকে বাদ দেয় এবং পরে চাকরিচ্যুত করে। এই পরিস্থিতি উপায়ান্তর না দেখে সালেহপৌর বাণিজ্যিক বিমান পরিচালানা সংক্রান্ত মার্কিন সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দেন।
তার এই অভিযোগ যাচাই ও তদন্ত শেষে ২০২১ সালে ড্রিমলাইনার সিরিজের উড়োজাহাজের উৎপাদন রাখতে বোয়িংকে লিখিত নির্দেশ দেয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ড্রিমলাইনার সিরিজের বিমান উৎপাদন স্থগিত রেখেছে কোম্পানি।
এনবিসিতে স্যাম সালেহপৌরের ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটি বিবৃতি দেয় বোয়িং কর্তৃপক্ষ। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বোয়িং খুবই পেশাদার একটি প্রতিষ্ঠান এবং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের বিমানগুলোর নিরাপত্তা ও মসৃণ উড্ডয়ন পরিষেবা সম্পর্কে কোম্পানি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী।
এ বিষয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে- ঠিক কী কারণে আহমেদাবাদে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ওই উড়োজাহাজের ডানাতে কোনো সমস্যা হয়ে থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে জানিয়েছেন। বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ জেফরি টমাস বিবিসিকে বলছেন, আমি যখন এই ভিডিওটি দেখছি, তাতে বিমানের চাকাসহ নিচের দিক, অর্থাৎ আন্ডারক্যারেজটা তখনো নামানো অথচ ডানার ফ্ল্যাপ গুটিয়ে ছিল।
বিমানের ডানায় যে ফ্ল্যাপ থাকে, সেগুলো খুলে বা বন্ধ করে আকাশে ওড়া বা মাটিতে নামার সময় বিমানের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জেফরি টমাসের কথায়, ডানা আর ফ্ল্যাপগুলো একই সমতলে ছিল। আকাশে ওড়ার পরে ওই সামান্য সময়ের মধ্যে এরকমটা খুবই অস্বাভাবিক। তার কথায়, আন্ডারক্যারেজ, অর্থাৎ চাকা সাধারণত ১০-১৫ সেকেন্ডে গুটিয়ে নেওয়া হয়, তবে ফ্ল্যাপগুলো অনেকটা সময় নিয়ে ১০-১৫ মিনিট ধরে গুটিয়ে নেওয়া হয়। আরেকজন বিশেষজ্ঞ টেরি টোজার বলছেন, মনে হচ্ছে না যে ফ্ল্যাপগুলো খোলা রয়েছে এবং এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে বিমানটি টেক অফ ঠিক মতো করতে পারেনি।
আহমেদবাদে ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনার পর একই ধরনের উদ্বেগ ও আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে বোয়িংয়ের সাবেক কোয়ালিটি ম্যানেজার জন বার্নেট বলেছিলেন- আমি এমন কোনো ড্রিমলাইনার দেখিনি যেটাকে আমি নিরাপদ বলতে পারি। জানা গেছে- বোয়িং এর মানহীন বিমান তৈরির তথ্যের হুইসেল ব্লোয়র ছিলেন এই জন বার্নেট। জন বার্নেট ৩০ বছরেরও বেশি সময় বোয়িং এ কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন বোয়িং এর একজন দক্ষ কর্মী। ২০১০ সাল থেকে বোয়িং-এর সাউথ ক্যারোলিনার নর্থ চার্লসটন প্ল্যান্টে কোয়ালিটি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন।
বার্নেট জানিয়েছিলেন, ২০১০ সাল থেকেই বোয়িং কর্মীদের উড়োজাহাজ তৈরির সময় নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হতো। বোয়িংয়ের ‘৭৮৭ ড্রিমলাইনার’ নামের এই অত্যাধুনিক প্লেন তৈরির সময় তিনি দেখতে পেলেন ভয়ঙ্কর কিছু চিত্র। ত্রুটিপূর্ণ পার্টস, স্ক্র্যাপ থেকে তোলা উপকরণ, এমনকি সেফটি টেস্টে ফেল করা যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লাগানো হচ্ছে প্লেনে।
দক্ষিণ ক্যারোলিনায় কাজ শুরু করার পর থেকেই বার্নেট লক্ষ্য করেন যে, নতুন উড়োজাহাজ তৈরির সময়সীমা পূরণের তাড়াহুড়ায় যন্ত্রাংশ লাগানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে আপস করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, কখনো কখনো উৎপাদন সময় মতো শেষ করার জন্য স্ক্র্যাপ বিন থেকে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ নিয়ে উড়োজাহাজে লাগানো হয়েছে, যা মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তিনি এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারকে জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বোয়িং ৭৮৭ কারখানার ইঞ্জিনিয়াররাও সমস্যাগুলো রিপোর্ট না করার জন্য চাপ দিতেন বলে বার্নেট দাবি করেন। তার মূল অভিযোগ ছিল- উড়োজাহাজের অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন যে, জরুরি অবস্থায় প্রতি চারটি অক্সিজেন মাস্কের মধ্যে একটি সঠিকভাবে কাজ করে না। তার মতে, ত্রুটিপূর্ণ অক্সিজেন ব্যবস্থার কারণে ৩৫,০০০ ফুট উচ্চতায় এক মিনিটেরও কম সময়ে যাত্রীরা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, এমনকি ৪০,০০০ ফুট উচ্চতায় মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যে এটি ঘটতে পারে, যা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
তার মতে, এইসব কিছুই হচ্ছিল একটাই কারণে - সময়ের মধ্যে প্রোডাকশন শেষ করতে হবে। সেফটি বা নিরাপত্তা? সেটা ছিল তালিকার একেবারেই নিচের দিকে। জন বার্নেট এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে তিনি কোম্পানির ভেতরে প্রতিবাদ করেছিলেন, রিপোর্ট করেছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উল্টো তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। তার অভিযোগ ছিল, বোয়িংয়ের সঙ্গে বিরোধের জেরে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে এবং তার কর্মজীবনে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু অবসরও দমাতে পারেনি তাকে। এ অবস্থায় ২০১৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) এবং অফিস অফ স্পেশাল কাউন্সিলে অভিযোগ করেন। কোথাও থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ২০২১ সালে তিনি নিজেই সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু শুনানির আগের দিন-১১ই মার্চ দক্ষিণ ক্যারোলিনার একটি পার্কিং লটে জন বার্নেটের মরদেহ পাওয়া যায় তার গাড়ির ভেতরে। তদন্তকারীরা জানান, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কিন্তু তার পরিবার এই দাবি মানতে রাজি ছিল না।- ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে নতুন করে মামলা করে তারা। এদিকে এয়ারইন্ডিয়ার ফ্লাইট ওই ফ্লাইট (এআই১৭১) দুর্ঘটনার পর জন বার্নেটের আগের অভিযোগগুলো আবার আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি এখন প্লেনের নিরাপত্তা আর যেসব কোম্পানি প্লেন বানায়, তাদের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। এই দুর্ঘটনার আসল কারণ খুঁজে বের করতে বার্নেটের অভিযোগগুলো কতটা গুরুত্ব পায়, সেটা এখন দেখার বিষয়।