ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, আমি পৃথিবীর রাজা

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ৮ জুন ২০২৫

এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, আমি পৃথিবীর রাজা

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পর্বতারোহী মোঃ শাকিল গড়ে তুলেছেন এক অনন্য ইতিহাস—তিনি বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি যিনি গ্রেট হিমালয় ট্রেল এবং সি টু সামিট (সমুদ্র থেকে এভারেস্ট) উভয় অভিযানে সফল হয়েছেন।

২০২৫ সালের ২২ মে স্থানীয় সময় ভোরে, ৮৮৪৮.৮৬ মিটার উচ্চতার পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন শাকিল। শিখরে দাঁড়িয়ে শাকিলের অনুভূতি ছিল, "আমি নই, বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর চূড়ায়।"

শাকিলের এই অভিযাত্রার পেছনে রয়েছে এক যুগের প্রস্তুতি। ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার ও এম এ মুহিতের সাফল্য তাকে প্রেরণা দেয়। ২০২২ সালে তিনি সম্পন্ন করেন গ্রেট হিমালয় ট্রেল—১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও দারুণ প্রতিকূল এই পথে এখন পর্যন্ত সফল হয়েছেন মাত্র ৩৩ জন পর্বতারোহী।

"১০৯ দিনে এই চ্যালেঞ্জ শেষ করার পর আমার মনে হয়েছিল, এভারেস্টের জন্য আমি প্রস্তুত," বলেন শাকিল।

২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে কক্সবাজারের ইনানি সৈকত থেকে তিনি শুরু করেন সি টু সামিট অভিযান। প্রতিজ্ঞা ছিল, কোনো যানবাহন নয়—শুধু হেঁটে এবং প্রয়োজন হলে সাঁতরে এগোবেন। যমুনা ব্রিজে হাঁটার অনুমতি না পেয়ে তিনি তিন কিলোমিটার নদীপথ সাড়ে চার ঘণ্টায় সাঁতরে পার হন।

এভারেস্ট অভিযানে মৃত্যুর ভয় যেন ছিল অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। বেস ক্যাম্প পৌঁছাতে সময় লাগে ৬৪ দিন। ক্যাম্প-৪-এ যাওয়ার পথে দেখতে পান মৃতদেহ—তারই এক ফিলিপাইন বন্ধু। সাউথ সামিট এবং হিলারি স্টেপেও একই চিত্র—প্রচণ্ড ঠান্ডা, ক্লান্তি ও মৃত্যুর ছায়া।

"হিলারি স্টেপে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, পায়ের নিচে ছিল এক মৃতদেহের মাথা। সামনে বন্ধুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপরে উঠছে, আর নিচে ঝুলছে লাশ—মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম," বলেন শাকিল।

চূড়ায় পৌঁছে যখন লাল-সবুজ পতাকা হাতে ছবি তুলছিলেন, শাকিল বলেন, "আমার চোখের পানি জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, চোখ আটকে যাচ্ছিল।"

বেস ক্যাম্পে ফিরে মাকে দেওয়া ভিডিও কলে তার চোখে মায়ের অশ্রু দেখে তিনি বলেন, "সব ভয়, সব ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল।"

শাকিলের যাত্রা শুধু সফলতা নয়, নতুন রেকর্ডও গড়েছে। অস্ট্রেলিয়ান পর্বতারোহী টিম ম্যাকার্টনি ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা থেকে ১১২৬ কিমি হেঁটে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। শাকিল সেই রেকর্ড ভেঙেছেন—তিনি হেঁটেছেন ১৩৭২ কিমি, সময় নিয়েছেন ৮৪ দিন (টিমের চেয়ে ১২ দিন কম)। টিমের বয়স ছিল ৪৫, আর শাকিলের বয়স এর চেয়েও কম।

কৃষক পিতার সন্তান শাকিল জানান, তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে একদিন এভারেস্ট ছুঁবে। বাবার মৃত্যুর পর মা সেই স্বপ্নকে আরও দৃঢ়ভাবে ধারণ করেন। আজ শাকিল শুধু সেই স্বপ্নই নয়, বাংলাদেশের গর্বের অংশ হয়ে উঠেছেন।

শাকিল এখন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন গ্রেট হিমালয় ট্রেল এবং সি টু সামিট উভয় অভিযান। তাঁর পদচিহ্ন পড়েছে ইনানির সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে এভারেস্টের চূড়ায়—এ যেন বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর এক জীবন্ত গল্প।

ফারুক

×