
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শন করেন
কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে ঢাল করে সাম্প্রতিক বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার পেছনে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মনে হলো এটা আর কিছু না। আমাদের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে বাংলাদেশকে আবার ভিক্ষুকের জাতি করে দেওয়া। এটাই বোধ হয় এটার পেছনে এদের ষড়যন্ত্র। সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুঃখজনক। এভাবে আর কেউ যেন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
দেশবাসীর কাছে আবারও বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার দেশবাসীর কাছে আমি বিচার চাই, অপরাধটা কি করেছি? যেখানে আমি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছি, মানুষের জীবন মান উন্নয়ন করেছি, আজকে ২০০৮ এর বাংলাদেশ আর ২০২৪-এর বাংলাদেশ তো এক না। বাংলাদেশের মানুষের জীবন মান তো উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি আজকে কত ওপরে উঠে গিয়েছিল। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যখন বাংলাদেশকে একটা জায়গায় নিয়ে আসলাম, আজকে সেখানে দেখি জ্বালাও-পোড়াও যে প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে সেবা দেয় সেখানে।
শনিবার কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সন্ত্রাসী হামলায় আহতদের দেখতে শেরেবাংলা নগরের পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটর) পরিদর্শন শেষে আবেগঘন কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। পরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মহাখালীতে অবস্থিত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতেই এই ষড়যন্ত্র। দেশের মানুষকেই এই সহিংসতার বিচার করতে হবে। আর কোটা আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউনের জন্যই এত মানুষ হতাহত হলো। এভাবে আর কেউ যেন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আজকে চিকিৎসার জন্য যা যা লাগবে করে দেব এবং করে দিচ্ছি। আর যাদের অঙ্গহানি ঘটেছে তাদের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের ব্যবস্থা নেবে সরকার। যাতে তারা আবার সুস্থ মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারে। নিজেদের কাজ করতে পারে। আমাদের যতটুকু সাধ্য তা আমরা করে দেব, কিন্তু আমার দেশবাসীর কাছে আমি বিচার চাই। অপরাধটা কি করেছি ? এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ আর কেউ যেন এ দেশে চালাতে না পারে এজন্য আমি সকলের সাহায্য চাই।
প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে গিয়ে গুরুতর আহত চিকিৎসাধীন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। আহতদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। তিনি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে আহতদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীসহ ডাক্তার, নার্স এবং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ জানান।
নিটর পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী শামীম উজ্জামান আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মহাখালীতে অবস্থিত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সংশ্লিষ্টরা এই সময় উপস্থিত ছিলেন। সরকার প্রধান একইসঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞও পরিদর্শন করেন।
টানা চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন আর তার ফলাফল আজকে এই অবস্থা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব একদিকে ছারখার। আর কত মানুষ প্রাণ হারাল, কতগুলো মানুষ আজকে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দাবি মেনে নেওয়ার পরেও তাদের সেই শাটডাউন কেন শেষ হচ্ছে না তা বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি বলেন, ২০০১ সালেও বিএনপি জামায়াত এ রকম তা-ব চালিয়ে ছিল। আওয়ামী লীগের প্রায় ২১ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। কত মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে, হাত-পা কেটে দিয়েছে, চোখ তুলে নিয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতন ও নারীদের পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আবার ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে আগুন সন্ত্রাস। চারিদিকে আগুন লাগানো, গাড়ির মধ্যে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা। আবার ২০২৩ সালে পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, আগুন সন্ত্রাস। নেতা-কর্মী মেরে গাছে ঝুলিয়ে রাখা, বার বার হামলার লক্ষ্যবস্তু করে পুলিশের ওপর হামলা- এটা কোন ধরনের রাজনীতি আমি জানি না।
মানুষের জীবন মান উন্নয়ন করাটাই তার অপরাধ কি না সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, আমি চাইনা আর কোনো মানুষের ক্ষতি হোক আর দেশবাসী এভাবে অসহায় হয়ে পড়ুক। সাম্প্রতিক সংঘাতে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির দায়-দায়িত্ব কার এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘কোটা তো আমি বাতিলই করে দিয়েছি। আমি আহ্বান করেছিলাম একটু ধৈর্য ধরো। সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি হবে, রায় দেয়। তারপরেও এই আন্দোলন, আজকে এতগুলো মানুষের জীবনের ক্ষতি হলো, এতগুলো পরিবারের ক্ষতি হলো- এর দায়-দায়িত্ব কাদের?
প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশটাকে যখন একটা জায়গায় নিয়ে আসলাম তখন জ্বালাও পোড়াও চারিদিকে। যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে সেবা দেয়। মেট্রোরেলে চড়ে কত অল্প সময়ের মধ্যে মানুষ গন্তব্যে পৌঁছাতে এবং ফিরতে পারতো। সেখানে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষ সকলেই যেতে পারতেন। সেই স্টেশনগুলো ধ্বংস করে এখন আবার ট্রাফিক জ্যাম আর মানুষের কষ্ট। কোভিড-১৯ চলাকালে যে হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা পেয়েছে সেখানেও আগুন দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা এভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষকে আবারও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিল তাদের বিচার এ দেশের মানুষকেই করতে হবে। আমি শুধু সকলের সহযোগিতা চাই। আর কোনো মায়ের কোল খালি হোক তা আমি চাই না। আমিতো বাবা-মা সব হারিয়েছি। আমিতো জানি হারাবার কত কষ্ট। সেই কষ্ট বুকে নিয়েই ’৭৫ এরপর রিফিউজি হিসেবে প্রবাস জীবন কাটাতে বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে এক রকম জোর করে ’৮১ সালে বাংলার মানুষের জন্য তার দেশে ফিরে আসা।
নিজের ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দেশে ফিরে আসার স্মৃতি রোমন্থন করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমি আমার সন্তানদের জন্য কতটুকুই বা করতে পেরেছি, নিজেরা চাকরি-বাকরি করে নিজেদের লেখাপড়া করেছে। কিন্তু বাংলার মানুষের জন্য করেছি। আজকে অন্তত মানুষের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, তাদের কাজের ব্যবস্থা সবইতো করে দিচ্ছিলাম। যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলাম তখন আবার এই তা-ব করে ঠিক যে জায়গাগুলো মানুষকে সেবা প্রদান করে সেই জায়গাগুলোতেই আঘাত।
শেখ হাসিনার সব অর্জনকে ধ্বংস করতেই এই হামলা ॥ হামলাকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সকল অর্জন ধ্বংস করতে চায় মন্তব্য করে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, হামলাকারীদের যে ফুটেজ ছিল, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেওয়া হয়েছে। তারা পরপর দুইবার পদ্মা সেতুতে আগুন লাগাতে গিয়েছিল। তারা শেখ হাসিনার সকল অর্জন ধ্বংস করতে চায়। এসব ধ্বংসযজ্ঞ দেখে প্রধানমন্ত্রী কষ্ট পাচ্ছেন।
শনিবার রাজধানীর বনানীতে ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে মন্ত্রী আরও বলেন, এটা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ না। বিএনপি-জামায়াত এই আন্দোলনের ওপর ভর করেছে। তাদের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার জন্য এমন হামলা। তারা গণতন্ত্র মানে না- তারা আগুন ও অস্ত্র নিয়ে নেমেছে।
মেট্রোরেল না থাকায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ৩০ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায়ও যেতে পারছে না। মেট্রোরেল কবে নাগাদ চালু হবে- তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আন্দোলনের ওপর ভর করে যারা রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন যেখানে যা করার, আমরা তাই করব।