
.
কারাগারের অভ্যন্তরে বসে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের ছক কষছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, প্রতিপক্ষকে খুন, রাহাজানিতে লিপ্ত তারা। জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত করার জন্য মাঠে নেমেছে পর্দার অন্তরালের একটি অশুভ চক্র। শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগারে বন্দি ইমন ও কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত মামুন গ্রুপের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিরোধের জেরে রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল নিহত হয়েছেন। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান।
কারাগার থেকে শীর্ষ অপরাধীরা যাতে বের হতে না পারে সেজন্য মামলার তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করা হচ্ছে। জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার আগে সব গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার বিজি প্রেসের সামনের রাস্তায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুনের প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে কারাগারে আটক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের সন্ত্রাসী বাহিনীর ৮ থেকে ১০ জন। এ সময় মোটরসাইকেলে করে ওই পথ দিয়ে নিজ বাসায় ফেরার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল। তাকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতালে, পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর পর রাত দেড়টার দিকে ভুবনকে পপুলার হাসপাতালে স্থানান্তর করেন স্বজনরা। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। ২৫ সেপ্টেম্বর সেখানে ভুবন চন্দ্র শীলের মৃত্যুর পর কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জেলগেটে আটক শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম রাশু : গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম ফ্রিডম রাসুকে কারাগারের জেলগেটে আটক করেছেন গোয়েন্দারা। রাসুর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, একাধিক হত্যা মামলাসহ মোট ১৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি মামলায় সম্প্রতি সে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পায়। সর্বশেষ একটি মামলার জামিনের কাগজপত্র বুধবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছে। জামিনের আদেশ যাচাই-বাছাই করার পর তাকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং ২১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলগেটের সামনে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস দাঁড়ানো ছিল। ফ্রিডম রাসু জেলগেট থেকে বের হওয়ার পর সাদা পোশাকের ২-৩ জন ব্যক্তি তাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে মাইক্রোবাসে চড়েন। এর পরই মাইক্রোবাসটি দ্রুতবেগে জেলগেট এলাকা ত্যাগ করে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মগবাজারের টিএন্ডটি কলোনিতে বেড়ে ওঠা খোরশেদ আলম রাসু ছিলেন ফ্রিডম পার্টির সদস্য। আশির দশকের শেষের দিকে ফ্রিডম পার্টির কর্নেল ফারুকের নেতৃত্বে দোর্দ- প্রতাপশালী গ্রুপ ছিল শাহজাহানপুরের ফ্রিডম মানিক ও মগবাজারের ফ্রিডম রাসু। ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ফ্রিডম মানিক, ফ্রিডম রাসুর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে ফ্রিডম রাসুর আধিপত্য বেড়ে যায় গোটা রাজধানীতে। ধানমন্ডি, কলাবাগান, মগবাজার, রামপুরা, মালিবাগ ও রমনা এলাকা ফ্রিডম রাসু-ফ্রিডম মানিকের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে বিজয়নগরে একজন রাজনৈতিক নেতার অফিসে ফ্রিডম রাসু, ফ্রিডম মানিক, ফ্রিডম সোহেল, জিসান আহমেদ মন্টি ওরফে জিসান ও মিরপুরের কেরামতের উপস্থিতিতে ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ গঠিত হয়। এই ফাইভ স্টার গ্রুপের বিপরীতে কাওরান বাজারের পিচ্চি হান্নান ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপ গঠন করে। মূলত এই দুই গ্রুপ গোটা রাজধানীর এলাকা ভাগ করে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে রাখত। ওই সময় খিলগাঁও ঝিলপাড়ে একটি মাছের ঘের নিয়ন্ত্রণ করত রাসু। ওই মাছের ঘেরে ঢাকার পূর্বাঞ্চল সব সন্ত্রাসীদের আড্ডা হত। ওই আড্ডায় জিসান, উপল, কেরামত, ইসতিয়ার থেকে শুরু করে অনেক গডফাদার অংশ নিত। খোরশেদ আলম রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু ছিল তালিকার ৬ নম্বরে।
২০০৩ সালের ১৫ মে রাতে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবির ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদার এবং এস আই আলমগীর হোসেনকে হত্যা করে শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম রাসু ও জিসান আলোচনা আসে। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে ধানম-ির আবাহনী খেলার মাঠের পাশ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে আটক করে। তার ফাইভ স্টার গ্রুপের অন্যতম সদস্য শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান পাড়ি জমায় দুবাইয়ে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানান, ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করে। এদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তালিকার প্রথম ৮ জনের জন্য ১ লাখ টাকা করে এবং তালিকার শেষ ১৫ জনের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী ২৩ জনের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। সুইডেন আসলাম, পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন।
জামিনে মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম : কারাগার সূত্র জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ মো. আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম প্রায় ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। এদিকে যেসব মামলায় খালাস পেয়েছেন সুইডেন আসলাম সেসব মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে সরকার। কোনো সাক্ষী না পাওয়ায় নব্বইয়ের দশকের আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম হত্যা, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র বহনের ১৬টি মামলা থেকেই খালাস পেয়ে গেছেন। বাকি আছে তেজগাঁওয়ের যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হক খান ওরফে গালিবকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলা। এই মামলায়ও যদি তিনি খালাস পান, তাহলে তাঁর কারামুক্ত হতে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ কারণে সুইডেন আসলামের সব মামলার আপিলের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
জামিনে মুক্ত হয়ে ভারতে চলে গেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ : পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ চন্দ্র জামিনে বের হয়ে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে গিয়ে আত্মগোপন করে আছে। বিকাশ চন্দ্রের মতো সুইডেন আসলামও কারাগার থেকে গোপনে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শঙ্কা প্রকাশ করে সুইডেন আসলাম গোপনে মুক্তি পেয়ে যাতে না বের হতে পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দী অবস্থায় কারা অধিদপ্তরের একটি দল অভিযান চালিয়ে তাঁর কাছ থেকে দুটি মুঠোফোন জব্দ করে। কারাগারে থেকেই মুঠোফোনে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালও জামিনে মুক্তির অপেক্ষায় : মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনে মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। বাইরে থাকা তাদের সহযোগী সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানমন্ডি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।
শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের জামিনে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা : মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে অভ্যন্তরে থেকে ও আত্মগোপনরত অবস্থায় প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি তাদের দ্বন্দ্বের জেরেই রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন বাহিনীর গুলিতে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেলখানায় থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ মামলায় খালাস বা জামিন পেয়েছেন, সেসব মামলায় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এসব আসামি জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার আগে সব গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মামলাগুলোর তথ্য সংগ্রহ নজরদারি করাসহ খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।