ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

​​​​​​​পাবনা-২

আওয়ামী লীগ বিএনপি দু’দলেই কোন্দল

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা

প্রকাশিত: ২২:২৫, ১৮ মার্চ ২০২৩; আপডেট: ২২:২৬, ১৮ মার্চ ২০২৩

আওয়ামী লীগ বিএনপি  দু’দলেই কোন্দল

.

পাবনা-২ সুজানগর আসনের রয়েছে অনেক অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সুজানগরের আদি নাম ছিল গোবিন্দগঞ্জ। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষভাবে তার পুত্রদের মধ্যে রাজসিংহাসনের দখল নিয়ে যে বিরোধের সূত্রপাত হয়,  তার ধারাবাহিকতায় যুবরাজ শাহ সুজা আরাকানে পালিয়ে যান। তিনি আরাকান গমনকালে সুজানগরে তিন রাত অবস্থান করেছিলেন। যুবরাজ শাহ সুজার এই অবস্থানকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এতদঞ্চলের মানুষ এ জনপদের নামকরণ করেন সুজানগর।

সুজানগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা, বেড়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে পাবনা-২ সংসদীয় আসন গঠিত। এ আসনে রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জোরেশোরে এখনও নির্বাচনী মাঠে না নামলেও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। অন্যদিকে কোন কোন সম্ভাব্য প্রার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থকগোষ্ঠীর ব্যানারে তার কর্মকান্ডের প্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ আসনে পাঁচবার আওয়ামী লীগ, তিনবার বিএনপি এবং একবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হায়দার আলী, ১৯৭৯ সালে বিএনপির এম এ মতিন, ১৯৮৬ সালে জাতীয়পার্টির প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সংসদ সদস্য হন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ওসমান গণি খান (ওজি খান) আওয়ামী লীগ প্রার্থী আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টারকে হারিয়ে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আহমেদ তফিজ উদ্দিন ১৫শ’ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী ওসমান গণিকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সেলিম রেজা হাবিব আওয়ামী লীগ প্রার্থী মির্জা আব্দুল জলিলকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের উপসর্বাধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার প্রায় ২৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট এ কে এম সেলিম রেজা হাবিবকে হারিয়ে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজিজুল হক আরজু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সবশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ এলাকার জনপ্রিয় সংসদ সদস্য মরহুম আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টারের জ্যেষ্ঠপুত্র আহমেদ ফিরোজ কবির আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট এ কে এম সেলিম রেজা হাবিবকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এলাকায় অত্যন্ত সাদাসিধা স্বজন মানুষ হিসেবে পরিচিত আহমেদ ফিরোজ কবির এবারও দলীয় মনোনয়নে অন্যতম প্রার্থী। এছাড়া রাকসুর সাবেক নেতা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সাবেক সহ সম্পাদক কামরুজ্জামান উজ্জ্বল দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কর্মসূচিসহ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে তৃণমূলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক সকল কার্যক্রমে অংশগ্রহণসহ সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখে পাশে আছেন ও থাকবেন।

এ আসনে ১৫ জন চেয়ারম্যান এক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সকল সাংগঠনিক কমিটির নেতৃবৃন্দ তার সঙ্গেই আছেন। তাই জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি এ আসনটি দলকে উপহার দিতে পারবেন।

সাবেক সংসদ সদস্য আজিজুল ইসলাম আরজু এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি কিছুদিন পুর্বে এলাকায় বড় শোডাউন করেছেন। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় আরও আছেন- আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সভাপতি ড. মির্জা এম এ জলিল, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা রাকসুর সাবেক জিএস ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খন্দকার জাহাঙ্গীর কবির রানা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওহাব এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সাবেক সদস্য সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশিকুর রহমান সবুজ।

অন্যদিকে, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হচ্ছেন- সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব, জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন, পাবনা জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আরশেদ আলম ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল হালিম সাজ্জাদ। তবে আসনটিতে সাবেক এমপি সেলিম রেজার বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে।

তবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আসনটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুদলই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগ দুধারায় বিভক্ত। একদিকে সভাপতি সাবেক মেয়র আলহাজ আব্দুল ওহাব, অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান শাহীন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।

গত ইউপি নির্বাচন ঘিরে দু’গ্রুপের বিরোধ আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। উপজেলার ১০টি ইউপি চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল ওহাব মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন পেলে সাধারণ সম্পাদক শাহীনুজ্জামান তাদের বিপরীতে একজন করে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করান বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের সবাই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবিরও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এ বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এমপি আহমেদ ফিরোজ কবির সাধারণ সম্পাদকের দিকে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ উঠলে নির্বাচিত আটটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সংসদ সদস্যের চরম বৈরিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, সুজানগরের আট ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বেড়ার পাঁচ ইউপি চেয়ারম্যান ও বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান যোগ দিলে এ আসনের ১৩টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবিরের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, দ্রুত এই বিভেদ নিরসন না হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়রথ ধরে রাখাই কষ্টকর হয়ে যাবে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা আরও অভিযোগে করেন, এই আসনের ১৩টি ইউনিয়ন ও সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির জানান, তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়েই এমন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। নির্বাচিত আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে বিদ্রোহীদের দিয়ে কাবিখা, কাবিটা প্রকল্প দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়ার্ড নেতাদের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় তা দৃশ্যমান হয়েছে। দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি আবারও এ আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দিতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। দলীয় কোন্দল মীমাংসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা তো আমাকে কিছু জানায়নি, তাই আমার কি করার আছে?

এদিকে, এই আসনে বিএনপিতেও অন্তর্কলহ প্রকট। সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সেলিম রেজা হাবিব ও তার অনুসারী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করায় বিভক্তি এখন সুস্পষ্ট। এ নিয়ে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সেলিম রেজা হাবিব এবারও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী। তার এ আসনে রয়েছে শক্ত অবস্থান।

তবে বিএনপির একটি অংশ অবশ্য ইতোমধ্যে প্রচার চালাচ্ছেন যে, কেন্দ্রীয় কৃষক দল সভাপতি হাসান জাফির তুহিন এ আসনে বিএনপির নিশ্চিত প্রার্থী হচ্ছেন। দলীয় হাইকমান্ড তাকে নির্বাচনের সিগন্যাল দেওয়ায় তার মনোনীত উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। তবে এ আসনে বিএনপির মনোনয়নের ওপর নির্ভর করছে তাদের জয় পরাজয় বলে তৃণমূল কয়েক নেতাকর্মী জানান। তবে এ আসনে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হোক না কেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছেন।

×