ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

ছোট কারখানা হুমকিতে

গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩

গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে

সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন দামে ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ ৬ খাতে দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ক্ষুদ্র শিল্পে ১৭৮ শতাংশ। এরপরই ১৫৪ শতাংশ দাম বেড়েছে মাঝারি শিল্পে। যা কার্যকর হবে ‘বিল মাস’ ফেব্রুয়ারি থেকে। তবে এত পরিমাণ দাম বাড়লেও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কায়ই রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এর আগে নিজেরাই বাড়তি দামে দিয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চাইলেও দাম বাড়ানোর পর তাদের মধ্যে বিরাজ করছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। রয়েছে সিস্টেম লসের শঙ্কাও। এতে করে ক্রেতা হারানোসহ ছোট কারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পরবে বলে দাবি তাদের। 
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের শিল্প কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয় আমাদের। তবে আমরা খোলা বাজার (স্পট মার্কেট) থেকে যে গ্যাস আনবে তার দামের সঙ্গে সমন্বয়ের শর্তে ২৫ টাকা পর্যন্ত দাম দিতে রাজি হয়েছিলাম। তবে তা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের শর্তে।

এখন যে পরিমাণ দাম বাড়ানো হয়েছে তাতে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত দেয়ার অবস্থা। করোনা পরবর্তী সময়ে আমরা যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি এমন একটা সময়ে প্রথমে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এবার শুধু শিল্প খাতেই বাড়ানো হলো কয়েকগুণ। এমন অবস্থা আমাদের কারখানাগুলো বিশেষ করে চিনি, প্লাস্টিক, গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বড় কারখানাগুলো সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা পেলেও ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

একই আশঙ্কার কথা জানান বাংলাদেশ নিটওয়্যার মেনুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের বার বার বলা হচ্ছে আমরাই বাড়তি দাম দিতে রাজি ছিলাম। কিন্তু এটা যে আমাদের দিয়ে বলানো হয়েছে এটা কেউ বলছে না। গত পড়শুও (মঙ্গলবার) সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হলো ২৮ টাকা করে দাম বাড়ানো হবে। কিন্তু এর একদিন পরেই কি দেখলাম? ৩০ টাকার ওপরে দাম বাড়ানো হলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হলো ক্ষুদ্র শিল্পে।

বড় কারখানাগুলোর ব্যাংক ঋণ সুবিধাসহ নানাধরণের সুবিধা থাকলেও তাদের কিন্তু কোনো সুবিধাই নেই। উপরন্তু কয়েকগুণ বাড়তি খরচের বোঝা তাদের পক্ষে কতটা বহন করা সম্ভব জানি না। করোনার সময়ও আমরা দেখেছি ছোট কারখানাগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো তাদেরই মাশুল দিতে হবে। তবে শুধু ছোট কারখানা নয় বড় কারখানাগুলোও কম ভুগবে না দাবি করে তিনি বলেন, দেখেন আমাদের যে ক্রেতা তাদের কাছ থেকে আমরা অন্তত : ৪ থেকে ৫ মাস আগে ক্রয়াদেশ পেয়ে থাকি।

এখন দেশে বিদ্যুতের মূল্যই বাড়লো নাকি গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ হলো তাতে তারা তাদের অবস্থান থেকে কোনোভাবেই সরে আসবে না। যে দামে পণ্যের ক্রয়াদেশ দিয়েছিল সেই দামেই পণ্য চাইবে। কিন্তু আমাদের তো সুতাই, ডায়িং, ক্যামিক্যাল সব কিছু কিনতে খরচ বেড়ে যাবে। এই বাড়তি খরছে যোগান আসবে কোথা থেকে?
তবে বাড়তি দাম নিলেও যেনো নিবরচ্ছিন্ন সরবরাহ পান সেই দাবি করেন পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি-মার্চে কারখানাগুলোতে আমাদের কাজ এমনিতেই কমে যায়। ক্রয়াদেশ না থাকায় এ সময়টায় অলসই কাটাতে হয় অনেক কারখানাকে। এমন সময়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সঠিক সময় নয় বলে আমি মনে করি।

যদি সিস্টেম লসটা কমানো যেতো তা হলে হয়তো আমাদের এই বাড়তি দাম দিতে হতো না। কিন্তু সরকার তা না করে বাড়তি দামের বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা বাড়তি দাম দিতে চেয়েছি কিন্তু তা অবশ্যই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের শর্তে। এখন যদি দামও বাড়ানো হয় আবার আগের মতোই নি¤œমানের সরবরাহ পাওয়া যায় তাহলে বাড়তি দাম দিয়ে আমাদের লাভটা হলো কি? সরকার কি তাহলে আবার দাম কমিয়ে দেবে? না দেবে না। তাই সিস্টেম লস কমিয়ে কোয়ালিটি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি জানাই সরকারের কাছে।
জানা যায়, গত ১৫ ডিসেম্বর বিডাতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং বিদ্যুৎ ও জ্বলানি প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গ্যাসের চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় জ্বালানি সচিব প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দেন। তবে ওই সভায় এ বিষয়ে আপত্তির কথা জানান ব্যবসায়ীরা।

পরে ২০ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই এক সভায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের শর্তে সর্বোচ্চ প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত করার পক্ষে মত দেয়। সভায় টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে ওই দিনই সালমান এফ রহমানের কাছে চিঠি দেয় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এ বিষয়ে মো. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ১৫ ডিসেম্বরের সভায় জ্বালানি সচিব প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

তবে আমরা ক্যালকুলেশন করে দেখিয়েছি, এটি সর্বোচ্চ ২২ টাকা হতে পারে। ৪০ টাকা কীভাবে হয় তার সঠিক ব্যাখ্যা তিনি আমাদের দিতে পারেননি। এরপর ২০ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই’র সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস ক্রয় করা হলে আমরা বাড়তি কিছু দাম দিতে রাজি। কিন্তু স্পট মার্কেট থেকে ক্রয় না করা হলে দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। তবে আমরা বলেছি, জনগণের জন্য ভর্তুকির দায় শিল্পের উপর যাতে না দেওয়া হয়। আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের শর্তে ২৫ টাকা পর্যন্ত দাম দিতে রাজি আছি। কিন্তু এখন যে পরিমাণ দাম বাড়ানো হয়েছে তা আমাদের জন্য সত্যি চাপের হয়ে দাঁড়ালো। 
সর্বশেষ গত জুন মাসে শিল্পে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের মূল্য (প্রতি কিউবিক মিটার) ১৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়। তবে মূল্য বাড়ানোর পর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে শিল্পে সংকট তৈরি হয়। বিটিএমএর পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের সদস্যভুক্ত গ্যাসভিত্তিক শিল্পগুলোর উৎপাদন ৪০ শতাংশে নেমে আসে গ্যাস সংকটের কারণে। তবে সম্প্রতি দেশের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এসি, বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। 
যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানির মূল্যের অস্থিরতার কারণে সরকারকে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, তবে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার আশা করেন, সরকার স্থানীয় শিল্প এবং বেসরকারিখাতের উপর যেন বেশি মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের মূল্য যৌক্তিকভাবে সমন্বয়ের লক্ষ্যে পরবর্তীতেও কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

তিনি বলেন, যেহেতু এটা দৃশ্যমান যে, বাংলাদেশ সরকার প্রতি মাসেই জ¦ালানির মূল্য সমন্বয় করার পরিকল্পনা করছে এবং সেই সংক্রান্ত একটি কৌশল নির্ধারনের কাজ চলছে তাই আমরা চাই সরকার যেন বিদুৎ ও গ্যাসের মূল্য সহনশীলভাবে এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে, যাতে করে, বেসরকারিখাত অপ্রত্যাশিত বর্ধিত ব্যয়ের বোঝা এড়াতে পারে। তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ জ¦ালানি আমদানির উপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল, এমতাবস্থায় নবায়নযোগ্য ও বিকল্প জ¦ালানির উৎস খুঁজে বের করতে এবং একই সাথে স্থানীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে প্রাধান্য দিতে হবে।

আরো পড়ুন  

×