
উদ্বোধনের পর মিতালী এক্সপ্রেস
উদ্বোধনের ৭ মাস পরেও পর্যাপ্ত যাত্রী পাচ্ছে না বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চালু হওয়া তৃতীয় আন্তর্জাতিক ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস। ভারতের দার্জিলিং সিকিম ভ্রমণে যাত্রীদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও বিড়ম্বনার কারণে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না এই ট্রেন। উল্টো দিন দিন কমে যাচ্ছে যাত্রী। বিকল্প হিসেবে সড়ক পথই বেশি ব্যবহার করছেন যাত্রীরা।
ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি লাইনে ট্রেন ভ্রমণে অতিরিক্ত সময় ব্যয় এবং গভীর রাতে ঢাকায় পৌঁছে গণপরিবহনের ভোগান্তিতে ট্রেনটির প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ কমছে। যাত্রীদের অভিযোগ, ট্রেনের যাতায়াতের সময় দশ ঘণ্টা নির্ধারিত থাকলেও ১৪/১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছেন, সিঙ্গেল লাইনের কারণে স্বাভাবিক গতিতে ট্রেন চালানো যায় না। অন্য ট্রেন চলাচলের সুযোগ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানের সিগন্যাল পেতে দেরি হয়। তবে আন্তর্জাতিক ট্রেন হিসেবে মিতালী এক্সপ্রেসকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে দাবি রেলওয়ে কর্মকর্তাদের।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহদাত আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা-কলকাতা রুটে বন্ধন, ঢাকা-কলকাতা রুটে মৈত্রী ও ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি রুটে মিতালীসহ এই তিনটি আন্তর্জাতিক ট্রেন চলাচল করে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে। অন্যান্য ট্রেন থেকে এই তিনটি ট্রেন সব সময় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়। তবে শীতের সময় ঘন কুয়াশা ও বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের সংস্কারের কাজ চলায় অনেক সময় সিগন্যাল পেতে একটু দেরি হয়। অন্য কোনো সমস্যার কারণে আন্তর্জাতিক ট্রেন দেরি হওয়ার কথা নয়।’
প্রতিনিয়ত বিলম্বে গন্তব্য ॥
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি নির্ধারিত সময় রাত পৌনে দশটায় ছেড়ে যায়। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সকাল সোয়া ৭টায় পৌঁছার কথা। ট্রেনটি ৬ জানুয়ারি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে বেলা সোয়া এগারোটায়। একইভাবে গত ১১ জানুয়ারি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে নির্ধারিত সময় বেলা পৌনে বারোটায় ট্রেনটি ছেড়ে আসে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছায় নির্ধারিত সময় রাত সাড়ে ১০টার পরিবর্তে পৌনে একটায়।
ঘোষণা অনুযায়ী প্রশাসনিক কাজের জন্য ট্রেনটি ভারতীয় সীমান্ত হলদিবাড়িতে কিছু সময় এবং বাংলাদেশ সীমান্তে চিলাহাটিতে কিছু সময় থামার কথা। এর বাইরে ট্রেনটি কোথাও থামার কথা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, ১১ জানুয়ারি ট্রেনটি এই দুই স্থান ছাড়াও ৯টি স্থানে যাত্রাবিরতি করেছে। এর মধ্যে পার্বতীপুর স্টেশনে থেমেছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপারে বসেছিল প্রায় এক ঘণ্টা। এ ছাড়া বাকি স্টেশনগুলোতেও ১৫/২০ মিনিট করে অপেক্ষা করেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপার্শ্বের স্টেশন থেকে ছেড়ে ট্রেনটি টাঙ্গাইল, মির্জাপুর, হাইটেক সিটি, মৌচাক, গাজীপুর, টঙ্গীর আগে আরও একটি স্থান, টঙ্গী, বিমানবন্দর এবং ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের আগে আরও একটি অজ্ঞাত স্থানে যাত্রা বিরতি করেছে।
টঙ্গী থেকে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছতে ট্রেনটি সময় নিয়েছে ৩৫ মিনিট। রেলের পরিচালককে জিজ্ঞেস করলে তিনি যাত্রীদের বলেছেন, সিঙ্গেল লাইনের কারণে অন্য ট্রেন পাসের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ট্রেন মাত্র তিনটি। এর মধ্যে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে প্রায় ৫৬ বছর পর চালু হয় ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি লাইনে ট্রেন চলাচল। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘটা করে ট্রেনটি উদ্বোধন করেন। স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক রুটের এই ট্রেনটি চলবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। অথচ অন্য ট্রেনকে পাস দেওয়ার জন্য ট্রেনটিকে স্টেশন কিংবা স্টেশনের বাইরে এগারো বার দাঁড়াতে হয়েছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক হিসেবে মন্তব্য করেছেন ভারত থেকে আগত একজন যাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি এই প্রথম ট্রেনটি চড়ে বাংলাদেশে যাচ্ছি।
আমার গন্তব্য বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা এলাকায়। আমার জন্য রাত ১০টা থেকে স্টেশনে গাড়ি অপেক্ষা করছে। এখন রাত পৌনে একটা। ইমিগ্রেশন-কাস্টমস শেষ করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। এত রাতে গাড়িতে করে ঢাকার বাইরে যাওয়া নিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি।’ ভুটান সীমান্তে একটি চা বাগানের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক ট্রেনের এমন সিডিউল বিপর্যয় হওয়া উচিত নয়। এমনভাবে লোকাল ট্রেনের মতো স্টেশনে স্টেশনে থেমে থাকাও কাম্য নয়। শুধু আমি কেন, ট্্েরনের যাত্রী যাদের নিজস্ব পরিবহন নেই তারা এত রাতে কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছবে এই শঙ্কা রয়েছে প্রত্যেকের মনে।’
ট্রেনটির জন্য পথে সময় রাখা হয়েছে দশ ঘণ্টা। যাত্রীরা মনে করেন এটি খুবই বেশি। সরাসরি একটি ট্রেন ৫১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এত সময়ের প্রয়োজন নেই। সীমান্তের দুই পারের আনুষ্ঠানিকতাসহ ৭/৮ ঘণ্টাই যথেষ্ট। দশ ঘণ্টা পরও যদি আরও ৩/৪ ঘণ্টা লেগে যায় তবে তা খুবই দুঃখজনক। মিতালী এক্সপ্রেসকে সফল করতে হলে এর সময় আরও দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক সময় ট্রেনটির গন্তব্যে পৌঁছা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এর প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ কমে যাবে। বিকল্প সড়ক কিংবা আকাশপথেই ফিরে যাবে সকল যাত্রী।
রেল কর্মকর্তাদের বক্তব্য ॥
আন্তর্জাতিক ট্রেনের সিডিউল দেখার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, গত ৫ ও ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রবেশের পর মিতালী এক্সপ্রেস ঢাকায় আসা-যাওয়ার পথে ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট দেরি হয়েছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে রেললাইন নির্মাণ ও ব্রিজ সংস্কারের কাজে আসা এবং যাওয়া পথে ৫০ মিনিট করে বেশি সময় লেগেছে। এ ছাড়া আরও ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট করে দেরি হয়েছে বিভিন্ন স্থানে ট্রেনের সিগন্যাল দিতে। এর বাইরে অন্য কোনো কারণে মিতালী এক্সপ্রেসের গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হয়নি।
গত বছর পহেলা জুন বাংলাদেশের ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি লাইনে চালু হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস। এই ট্রেনে এসি বার্থ, এসি সিট ও এসি চেয়ার আসনে মোট ৪৫৬ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতা। উদ্বোধনের ৭ মাসেও ট্রেনটি প্রত্যাশিত যাত্রী আকর্ষণ করতে পারেনি। এখনো অর্ধেকের কম যাত্রী নিয়েই চলাচল করছে মিতালী এক্সপ্রেস। গত রবিবার ১১৭ জন নিয়ে ঢাকা এসেছে ট্রেনটি। সোমবার ১৩৬ জন নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।
যাত্রী কম হওয়ার কারণে তেমন আয় হচ্ছে না বলে জানান কর্মকর্তারা। মিতালী এক্সপ্রেস ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছাড়ে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার। আর ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় প্রতি রবি ও বুধবার। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রডগেজ ট্রেনের কোচ নেই। এজন্য ভারতের কোচ দিয়ে মিতালী ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে।