ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের খসড়া সংশোধন বাস্তবায়নে স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব বিস্তার 

তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়নের পথে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন!

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ১১ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৯:৪০, ১১ ডিসেম্বর ২০২২

তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়নের পথে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন!

তামাক

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি সংশোধনের লক্ষ্যে বেশ কয়েকমাস ধরেই কাজ চলছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নের লক্ষ্যে ওয়েবসাইটে প্রেরিত আইনের খসড়ার উপর প্রাপ্ত মতামতের আলোকে চুড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে স্বাস্থ্য সচিব ড. মু: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এর সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃ মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আইনের সংশোধনী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তা মন্ত্রিসভা বিভাগে প্রেরণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জোর তাগাদা দেন। কিন্তু হঠাৎ তড়িঘড়ি করে কেন এই আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে? অভিযোগ আছে কিছু অপ্রাসঙ্গিক স্বার্থান্বেষী মহল প্রভাব বিস্তার করছে এই আইনের খসড়া বাস্তবায়নে।

সাধারণত, যে কোনো আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগ, সংশ্লিষ্ট সেক্টরের প্রতিষ্ঠান/অ্যাসোসিয়েশন, শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন, ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সবার আলোচনার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে সেই খসড়া মন্ত্রিপরিষদ সভায় অনুমোদিত হয়ে সংসদীয় কমিটিতে যায়। কমিটিতে অনুমোদন হয়ে গেলে তা সংসদে পাশ হয়। 
তবে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বরাবরের ন্যায় এবারও অনুষ্ঠিত সভাতে উপেক্ষিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট অংশীজন বা স্টেকহোল্ডারগণ! সংশ্লিষ্ট শিল্পের প্রতিনিধিগণ তো উপস্থিত ছিলেনই না, এমনকি এই সভাতে উপেক্ষিত হয়েছে এফবিসিআই, নাসিব এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক কিছু প্রতিষ্ঠানও। 

উল্লেখ্য, ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত)’ সংশোধনের জন্য একটি কমিটি ও একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু এই কমিটি ও সাবকমিটিতে বিভিন্ন এনজিওর উপস্থিতি ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। কমিটির ১৯ জনের মধ্যে ১১ জন আর সাবকমিটির ১২ জনের মধ্যে ছয়জনই ছিলেন এনজিও ও বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। বাংলাদেশের মতো সদ্য মধ্যম আয়ের দেশের জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ছাড়া এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন বাস্তবায়ন করা যুক্তিযুক্ত নয় কারণ স্বভাবতই বিদেশি এনজিও এবং কিছু স্বার্থান্বেষী মহল দেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা না করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করবে যা দেশের এইরূপ অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে কোনভাবেই কাম্য নয়। 

তামাক খাতের সাথে প্রায় দেড় লাখ তামাক চাষি থেকে শুরু করে ১৫ লক্ষ সিগারেট বিক্রেতা এবং এর সাথে যুক্ত বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিস এর কারণে এই খাতের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। তড়িঘড়ি করে আইনটি কার্যকর হলে উক্ত খাতের সাথে জড়িত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ব্যবসায়িক জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশী বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়াও এই ত্রুটিপূর্ণ আইনের অপপ্রয়োগ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে যা মাঠ পর্যায়ে হয়রানি এবং নকল পণ্য বৃদ্ধির উদ্বেগ সৃষ্টি করবে। ফলশ্রুতিতে এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং রাজস্ব আহরণের উপর বিরূপ প্রভাব বয়ে আনবে।


২০০৫ সালে যখন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০১৩ সালে যখন আইন সংশোধিত হয় তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তামাক খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি ও অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্বপূর্ণ মতামত নিয়ে তা প্রণয়ন করে এবং পরে বাস্তবায়ন করে। এরই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে ধূমপায়ীদের সংখ্যা ২০১০ সালে থেকে ২০২০ সালে ৪৪ শতাংশ থেকে ৩৪.৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। 

উক্ত বৈঠকটি যদি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকই হয় তাহলে এখানে বিদেশি এনজিওদের কেন আমন্ত্রণ করা হলো তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। আর যদি এই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের থাকতেই হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগ, সংশ্লিষ্ট সেক্টরের প্রতিষ্ঠান/অ্যাসোসিয়েশন, শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন, ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের অগ্রাধিকার অনস্বীকার্য। নীতি প্রণয়নের চেয়ে এনজিওগুলো যদি নীতি বাস্তবায়নে বেশি গুরুত্ব দিত তাহলে বরং দেশ ও জনগণের জন্য পদক্ষেপটি বেশি ভালো হত। উদাহরণস্বরূপ, তামাক পণ্যের গায়ে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদর্শনের আইনটি সিগারেট ছাড়া অন্যান্য তামাক পণ্যের জন্য এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। 

তাই বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়নে গুরুত্ব না দিয়ে, তড়িঘড়ি করে নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়টি হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে বার বার সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের উপেক্ষিত করে তড়িঘড়ি করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের চেষ্টা যা দাতা সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক এনজিওদের স্বার্থ উদ্ধারের পথকে সুগম করতে যেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। নইলে তা হবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। 

 

এস.রহিম

সম্পর্কিত বিষয়:

×