ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যু বেড়ে ৬৮

করতোয়ায় আরও ১৮ লাশ উদ্ধার

এ রহমান মুকুল, মাড়েয়া থেকে

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

করতোয়ায় আরও ১৮ লাশ উদ্ধার

নৌকাডুবির ঘটনায় স্বজনহারাদের আহাজারি

দিন যতই যাচ্ছে লাশের সংখ্যা ততই বাড়ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত গত তিন দিনে ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ৩০, পুরুষ ১৭ ও শিশু ২১ জন। সরকারী হিসাব মতে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ ৪ জন রয়েছেন। সোমবার সন্ধ্যার পর উদ্ধার কাজ স্থগিত করার পর মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু করা হয় উদ্ধার অভিযান। এর আগে করতোয়ার বিভিন্ন স্থানে ভেসে ওঠে লাশের পর লাশ। জলে ডোবা এসব লাশ ফুলে যায় এবং অর্ধগলিত হওয়ায় লাশের উৎকট গন্ধে এলাকায় টেকা দায় হয়ে পড়ে।

এর পরও নাকে কাপড় বেঁধে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় একের পর এক লাশ উদ্ধারের পর তা মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে নিয়ে আসছেন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা। পচন ধরা লাশের গন্ধ উপেক্ষা করে প্রিয়জনকে শনাক্ত করতে পরিবারের সদস্যরাও ছুটে আসছেন।  এরপর শনাক্ত হতেই আঁতকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও বুকে পাথর আর মুখে কাপড় চেপে মৃত স্বজনের লাশ নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের এক পলক দেখার সুযোগ দিয়ে লাশ নিয়ে ছুটছেন স্থানীয় শ্মশানঘাটে।

করতোয়ার আউলিয়া ঘাট থেকে মাড়েয়া ও পাশর্^বর্তী এলাকার শ্মশানঘাটগুলোতে শুধু লাশ আর লাশ। এ যেন হৃদয় বিদারক দৃশ্য। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, পঞ্চগড়ের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। হাঁটুজলের নদী হিসেবে পরিচিত করতোয়ার জলে ডুবে একসঙ্গে ৬৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর চিরচেনা করতোয়া যেন অচেনা হয়ে পড়েছে। হবেই না কেন। স্বজন হারানোর বুক ফাটা আর্তনাদ যেন থামছেই না।

এতগুলো প্রাণহানির জন্য কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও ঘাট ইজারাদারের অবহেলাকে দায়ী করছেন মৃতদের স্বজনসহ এলাকাবাসী। মাড়েয়ার বটতলী, শালডাঙ্গাসহ আশপাশের বিভিন্ন ফুটকীবাড়ি শ্মশানঘাটে গিয়ে দেখা গেছে,  নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া লাশ সৎকার করা হয়েছে। আবার  কোন পরিবার তাদের প্রিয়জনের লাশ পোড়ানোর জন্য চিতায় নিচ্ছেন। আগুনে প্রিয়জনের লাশ পোড়ালেও স্বজনদের শোক পোড়াবেন কীভাবে, সে প্রশ্ন স্বজন হারানো পরিবারের চোখেমুখে।
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে রাখা লাশের শনাক্ত করতে আসেন মাড়েয়ার গড়দিঘীর পুণ্য (৫৫) কলেজ পড়ুয়া ছেলে পলাশের (১৭) ছবি নিয়ে। ঘটনার দুই দিন পর ছেলের লাশ পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। একমাত্র ছেলের অর্ধগলিত লাশ প্রশাসনের কাছ থেকে বুঝিয়ে নিয়ে দাহ করতে নিয়ে যান শ্মশানঘাটে। বোদা ময়দানদিঘীর খালপাড়া গ্রামের হিমালয় (৩৫) এখনও নিখোঁজ রয়েছে।

মহালয়ার দিন তিনি তার স্ত্রী স্বপ্না রানীকে নিয়ে নৌকাডুবির শিকার হন। তার স্ত্রী বেঁচে গেলেও হিমালয়কে গত তিনদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনরা। মলিন (৩৫) জানান, তার চাচাতভাই হিমালয় দেড় মাস আগে বিয়ে করেন। বোদা উপজেলার সাকোয়ারহেমন্ত বর্মণ নৌকাডুবির সময় ওই নৌকার যাত্রী ছিলেন। নৌকাটিতে অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে মাঝ নদীতে গিয়ে দুলতে দুলতে এক পর্যায়ে পানিতে ডুবে যায়। তিনি কোনমতে সাঁতরে নদী পাড়ে আসেন। মাড়েয়ার বাসিন্দা মজনু বলেন, কোনদিন তিনি এত মানুষের প্রাণহানি এই এলাকায় দেখেননি। তার ৩৪ বছরের জীবনে তো বটেই তার বাপ-চাচারাও এত মৃত্যু একসঙ্গে দেখেননি।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে রেলপথ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ওয়াহিদুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মোঃ জহুরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
পরে রেলপথ মন্ত্রী, মৃত পরিবারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন।
এদিকে, দুর্ঘটনাস্থলের ভাটি অংশ থেকে একে একে উদ্ধার হতে থাকে মরদেহ। দুর্ঘটনার নিহত স্বজনদের দাবি ধীরগতিতে উদ্ধার কাজ চলার কারণে এখনও অনেক মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় উদ্ধারকারীরা জানান, মরদেহ উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের কোন অবদান নেই। স্থানীয়রাই নিজ উদ্যোগে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। হাত ধরে কয়েকজন দল বেঁধে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছেন স্থানীয় উদ্ধারকারীরা। উদ্ধারকারীদের অভিযোগ সকাল থেকে সারাদিন তারা উদ্ধার কাজ চালালেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের কোন ধরনের খাবার ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে না।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই নিখোঁজ স্বজনের মরদেহের খোঁজে করতোয়া নদীর আউলিয়াঘাট ও এর আশপাশের এলাকা এবং মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে খোলা তথ্যকেন্দ্রে ভিড় করতে থাকে। স্বজন হারারা বলছেন, এখন আর জীবিত উদ্ধারের সুযোগ নেই। তিনদিন ধরে লাশের জন্য হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তারা তাদের স্বজনের মরদেহটি দ্রুত উদ্ধার করে দেয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

তথ্যকেন্দ্রের সামনে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে গত দু’দিন ধরে অপেক্ষা করছেন বোদা উপজেলার মাড়েয়া কাউয়াখাল গ্রামের সন্তোষ কুমার। তিনি জানান, ওই দিন নৌকায় তার পুত্রবধূ সুমিত্রা ও নাতি সজিব (৭) ছিল। পুত্রবধুর লাশ পেলেও এখনও নাতির লাশ খুঁজে পাননি তিনি।
বোদা পৌরসভার কলেজপাড়া স্কুলশিক্ষক দীপক চন্দ্র রায় ও ছন্দা রানী দুই মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। রবিবারের নৌকাডুবিতে তাদের বড় মেয়ে পঞ্চগড় সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর দিবা শাখার শিক্ষার্থী ভূমিকা রানী রায় ও বৃষ্টি রানী রায় মারা গেছে। শোকের মাতম চলছে গোটা বাড়িতে। ভূমিকার বান্ধবী পঞ্চগড় পৌর এলাকার ইসলামবাগের লুবাবা রহমান অর্থি জানায়, ভূমিকার সঙ্গে স্কুলে তার শেষ দেখা হয়েছিল ১৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন থেকে এসএসসি পরীক্ষার জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। ভূমিকা তাকে দুর্গাপূজার বিজয়া দশমিতে তাদের বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল।
বোদা উপজেলার মাড়েয়া ফুটকিবাড়ী এলাকার জয় জানান, রবিবার বোদেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার জন্য আমার ৭ জন আত্মীয় উঠেছিল। শুরুতেই একটি শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে সুস্থ হওয়ার পর তাকে বাড়িতে এনেছি। স্থানীয় উদ্ধারকারীরা ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। ফায়ার সার্ভিস কোন কাজ করেনি। তারা আমাদের কোন উপকার করছে না। এখনও একজন শিশু নিখোঁজ রয়েছে।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপংকর কুমার রায় জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনদিনে সর্বমোট ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বোদা উপজেলার ৪৫ জন, দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৭ জন, আটোয়ারী উপজেলার ২ জন, পঞ্চগড় সদরের ১ জন এবং ঠাকুরগাঁও সদরের ৩ জন। তিনি আরও জানান, আমাদের তালিকা অনুযায়ী ৪ জন নিখোঁজ রয়েছে। এ কারণে বুধবারও উদ্ধার অভিযান চলবে।

×