শংকর কুমার দে ॥ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর করতে কত দিন লেগে যেতে পারে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তবে ফাঁসির কার্যকর বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে এমনটাই উদাহরণ। ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য বছরের পর বছর লেগে যাওয়ার অন্যতম কারণ ডেথ রেফারেন্স জট। দেশের ৬৮ কারাগারে ফাঁসির আসামি দুই হাজারের বেশি। মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের ফাঁসি কার্যকর করার আগে অন্তত চারটি ধাপ নিষ্পত্তি করতে হয়। এর মধ্যে বিচারিক আদালত, উচ্চ আদালত, সর্বোচ্চ আদালত (আপীল বিভাগ) ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। এসব আইনী প্রক্রিয়ার ধাপ পেরিয়ে একজন আসামির ফাঁসি কার্যকর করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। আদালত ও কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
জানা গেছে, ডেথ রেফারেন্সের জটে কনডেম সেলে ফাঁসির আসামি বাড়ছে। হাইকোর্ট বেঞ্চে ৬ বছর আগের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামির ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি চলছে। এই হিসাব অনুযায়ী এখন যাদের নি¤œ আদালতের রায়ে ফাঁসি হয়েছে তাদের ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে চলে যেতে পারে প্রায় ২৬ সাল পর্যন্ত। আর হাইকোর্ট যদি কোন আসামির মৃত্যুদ- হাল রাখেন, তাহলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ ফাঁসির আসামির রায় কার্যকর হতে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত চলে যেতে পারে। যতদিন পর্যন্ত ফাঁসির আসামির মামলার রায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হবে ততদিন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের কনডেম সেলে থাকতে হবে। সর্বশেষ মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত।
উচ্চ আদালত সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত বিচারের আগে কনডেম সেলে থাকা মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের ফাঁসি কার্যকর করার আগে অন্তত চারটি ধাপ নিষ্পত্তি করতে হয়। এর মধ্যে বিচারিক আদালত, উচ্চ আদালত, সর্বোচ্চ আদালত (আপীল বিভাগ) ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। বিচারিক আদালত যেহেতু চূড়ান্ত বিচার নয়, সেহেতু একজন মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকতে হবে। মৃত্যুদ-ের একটা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে ২০ বছর সময় লেগেছে এমন উদাহরণও আছে। হাইকোর্টে কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিন আসামি সম্প্রতি একটি রিট করার শুনানিতে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে। জানা যায়, বিচারিক আদালত কোন আসামিকে মৃত্যুদ-ের সাজা দিলে সেটিকে কার্যকর করতে অনুমোদন লাগে হাইকোর্টের। এটিকেই ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদ- অনুমোদন বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপীল বিভাগে আপীল করতে পারে। আর আপীলে আসা সিদ্ধান্তের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনও করার সুযোগ আছে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়, যেখানে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য, বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকে।
সুপ্রীমকোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরে ৯৬৯টি ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১২৬টি। এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে ৮৪৩টি মামলা।
এসব মামলায় সারাদেশে ৬৮ কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী ২ হাজার ২৫৩ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রয়েছে। বর্তমানে ২ হাজার ১৫৩ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামির মধ্যে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে আসে ১১৪টি মামলায় ২৩০ জন, ২০১৬ সালে ১৬১টি মামলায় ৩৩৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭১টি মামলায় ৩৯১ জন, ২০১৮ সালে ১৫৪টি মামলায় ৩৯৮ জন, ২০১৯ সালে ১৬৪টি মামলায় ৩৭০ জন, ২০২০ সালে ১২৩টি মামলায় ২৫৪ জন এবং ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২টি মামলায় ১৭৫ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রয়েছেন। যারা বর্তমানে কারাগারের কনডেম সেলে আছেন। হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি চলছে। সে হিসাবে চলতি বছর যেসব আসামি নি¤œ আদালতে মৃত্যুদ-ে দ-িত হচ্ছেন, তাদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি হবে ২০২৬ সালে। ফলে একজন ফাঁসির আসামিকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। আর হাইকোর্ট যদি কোন আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখেন, তাহলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে তাকে।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। প্রতিবছর যতসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে, এর অর্ধেকও নিষ্পত্তি হয় না। ফলে দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনা, আদালতের বার্ষিক ছুটি এবং বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ভাঙ্গার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে ভাটা পড়ে যায়। বর্তমানে হাইকোর্টে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, নুসরাত হত্যা, রিফাত শরিফ হত্যা মামলাসহ বেশকিছু আলোচিত মামলার আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। এছাড়া আপীল বিভাগে চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ হত্যা ও পিলখানা হত্যাসহ শতাধিক আপীল রয়েছে শুনানির অপেক্ষায়।
হাইকোর্টের একজন আইনজীবী বলেন, যেহেতু মৃত্যুদ- নিশ্চিত হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় সে কারণে ফাঁসির আসামিকে কনডেম সেলে থাকতে হয়। আপীল ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পরই এ সেলে রাখা যেতে পারে। একটি মৃত্যুদ- মামলার শুনানি করতে সময় লাগে হাইকোর্টে ছয় বছর আর আপীলে লাগে ছয় থেকে ১০ বছর। এভাবে ১৫ বছর থেকে ২০ বছর লেগে যায়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অনেকের মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। আবার অনেকের ডেথ রেফারেন্স শেষ হওয়ার পর আপীল করেছেন। সেটা আপীল বিভাগে বিচারাধীন। বছরের পর বছর ধরে কনডেম সেলে ফাঁসির আসামিকে কাটাতে হবে। সম্প্রতি এমন বেশকিছু পুরনো মামলায় মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামিকে বিচার শেষে আপীল বিভাগ খালাস দিয়েছেন। কাউকে দিয়েছেন যাবজ্জীবন, আবার কারও মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন। তবে হাইকোর্টে বেশকিছু ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স জটের অন্যতম কারণ হলো বিচারিক আদালতে ফাঁসির আদেশের সংখ্যা বাড়ছে। হাইকোর্টে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ বিচারকের সঙ্কট রয়েছে। মৃত্যুদ- অনুমোদনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকে বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডেথ রেফারেন্সের জটে কনডেম সেলে ফাঁসির আসামির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা। এই মামলা জটের কারণে কারাগারের কনডেম সেলে বছরের পর বছর বন্দী দুই সহস্রাধিক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। কারাগারের কনডেম সেল বা বিশেষ সেলে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও দুর্র্ধর্ষ আসামিদের একটি বিশেষ সেলে রাখা হয়। সার্বক্ষণিক তাদের মনিটরিং করা হয়। সর্বশেষ সিনহা হত্যাকা-ের ফাঁসির আসামি প্রদীপ দাশ ও লিয়াকত আলীকে কনডেম সেলে নেয়ার পর সার্বক্ষণিক মনিটরিং-এর আওতায় আনা হয়েছে।