ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

উৎসব না হলেও বই পাবে সব শিক্ষার্থী

নতুন বইয়ের ঘ্রাণে আজ মাতোয়ারা হওয়ার দিন

প্রকাশিত: ২২:৪১, ১ জানুয়ারি ২০২২

নতুন বইয়ের ঘ্রাণে আজ মাতোয়ারা হওয়ার দিন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ করোনা মহামারী সতর্কতায় বছরের প্রথম দিন আজ হচ্ছে না বই উৎসব। তবে উৎসব না হলেও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে আজ তুলে দেয়া হবে নতুন বই। একদিনেই সব বই দেয়া সম্ভব না হলেও পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী পাবে এ বই। উৎসবের আতিশয্য না থাকলেও উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা যায়, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটির মতো শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য তারা প্রায় ৫ কোটি বই ছাপার কাজ করছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের মোট বই ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ২০২টি। আর প্রাথমিক স্তরের মোট বই প্রায় ১০ কোটি। প্রাথমিক স্তরে সব বই ছাপা হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেলেও মাধ্যমিকের এখনও ছাপার বাকি প্রায় ৭ কোটি বই। তবে আজ প্রথম দিন প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সদ্য বিদায়ী এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মাধ্যমিকের প্রায় ২৫ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রায় সব বইই ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চলে গিয়েছে দেশের বিভিন্ন স্কুলে। আর এর প্রেক্ষিতেই ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বই বিতরণ কর্মসূচীর উদ্বোধন করেছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় বই উৎসব না হলেও সব শিক্ষার্থীর হাতে যাবে নতুন বই। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার বই বিতরণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি জানিয়েছেন, এবার নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য সারাদেশে ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০ কপি বই বিতরণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার যে বই বিতরণ করা হচ্ছে, তার মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক ও পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃভাষায় প্রণীত পাঠ্যপুস্তক রয়েছে। সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পৌঁছানোর বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির উপদেষ্টা তোফায়েল খান জনকণ্ঠকে বলেন, মোট ৩৫ কোটি বইয়ের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৭ কোটি বই ছাপানোর কাজ এখনও বাকি। এনসিটিবির দরপত্রের বিধিমোতাবেকই জানুয়ারি মাস পুরোটা ছাপার কাজ চলবে এবং সরবরাহ করা যাবে। তাই আমরা মনে করছি, ১ জানুয়ারির (আজ) মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাবে না। তবে যে সব বই ছাপা হয়েছে, সেগুলো শিক্ষার্থীরা পাবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, মাধ্যমিকের জন্য আমাদের ওয়ার্ক অর্ডারের মেয়াদ আছে জানুয়ারি পর্যন্ত। তবে প্রাথমিকের জন্য মেয়াদ শেষ। একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের কিছু জটিলতা ছিল, যেটির নাম অগ্রণী প্রকাশনী। তারা বই সরবরাহের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেছে। তাদের ৩ সপ্তাহ সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের সময় বাড়ানো হয়েছে। তাদের বই ১ জানুয়ারির মধ্যে যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। এতে করে প্রাথমিকের অন্তত ১০ শতাংশ বই বাকি থাকবে বলে আমরা অনুমান করছি। এছাড়া, মাধ্যমিকের বইয়ের ক্ষেত্রে অস্টম ও নবম শ্রেণীর বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবি থেকে ৯ নবেম্বর থেকে ৮৪ দিন সময় বেঁধে দেয়া আছে। আর ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণীর জন্য ৯ নবেম্বর পর্যন্ত ৭০ দিন সময় দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের হাতে সময় আছে। তবে জাতীয় স্বার্থে আমরা বইগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরবরাহ করতে চাই। মুদ্রণ শিল্প সমিতির এই নেতা আরও জানান, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজ শুরু এবং শেষের দিকে থাকলেও প্রি-প্রাথমিকের ওয়ার্ক অর্ডারই এখন হয়নি। এর জন্য পুনর্দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে গত ৮ ডিসেম্বর। এখন ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু হয়নি। তাই এটির ছাপার কাজ শুরু করা সম্ভবই হয়নি। যদিও অনুশীলন খাতা সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যবই ছাপা শুরু হয়নি এখনও। এ ক্ষেত্রে এই শ্রেণীর বই কবে নাগাদ সরবরাহ করা সম্ভব হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। এদিকে, নতুন বই পাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনছে শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী নিলয় তানভীর বলে প্রতিবছর বই উৎসবের মধ্য দিয়েই নতুন বই নিয়ে ঘরে ফিরতাম। তবে এবার করোনার কারণে বই উৎসব হচ্ছে না। তবও নতুন বই তো পাচ্ছি! এতেই স্বস্তি। উচ্ছ্বসিত রাজধানীর ইস্পাহানী গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নবনীতাও। বলে, পুরো একটা বছর অপেক্ষা করি নতুন বই পাওয়ার জন্য। কাল (আজ) নতুন বই পাব। এ যে কি আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না কাউকে। এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ৩২ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩৫ জন শিক্ষার্থীকে ৬৬ লাখ ৬ হাজার ৪৮০টি বই বিনামূল্যে বিতরণের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে এই শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৩ হাজার ১৯৩ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দেয়া হবে ৯ কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ১৭৭টি। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৯৩ হাজার ৯৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য বইয়ের সংখ্যা ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৬৪টি। ফলে শুধু প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্তরের মোট ২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৮২২ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার ২১টি। এছাড়া, মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ি স্তরের ৩৫ লাখ ৪ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থীকে সরবরাহ করা হবে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৯২টি বই। একই শিক্ষাবর্ষে দাখিল স্তরের ২৭ লাখ ১২ হাজার ২ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দেবে ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৫৯ হাজার ৭৮৩টি। তবে বিনামূল্যে সরবরাহের সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি বই বিতরণ হবে মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন) স্তরে। এই ধাপের ১ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার ৯০৫ জন শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে ১৭ কোটি ৯৪ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭৭টি বই। এছাড়া, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে কারিগরি স্তরে ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮ জন শিক্ষার্থীকে ২৪ লাখ ৪২ হাজার ৮৫৮টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। একইভাবে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল স্তরে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৮৩ জন শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে ৩৩ লাখ ১৫ হাজার ১৯২টি বই। এছাড়া ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক ৮ হাজার ৫৪টি দেয়া হবে ৯৬৩ জন শিক্ষার্থীকে। এতে করে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মোট ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে মোট বই বিতরণ করা হবে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ১৬ হাজার ২৭৭ টি। এর আগে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে একইভাবে মোট ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বই। ফলে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের চাইতে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে বইয়ের চাহিদা বেড়েছে ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার ৮৬৫টি। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এনসিটিবি সূত্রে আরও জানা যায়, আলাদা আলাদা দরপত্রের মাধ্যমে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন), ৮ম ও ৯ম শ্রেণী, ইবতেদায়ি স্তরের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণী, দাখিল স্তরের ৮ম ও ৯ম শ্রেণী এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল স্তরে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হবে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৯৭১ কপি, মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী, ইবতেদায়ি স্তরের ১ম ও ২য় শ্রেণী দাখিল স্তরের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীর এবং কারিগরি (ট্রেড বই) স্তরে দেয়া হবে ১ কোটি ৭ লাখ ৫২ হাজার ৮৪০ কপি, মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন) স্তরের ৮ম ও ৯ম শ্রেণী ইবতেদায়ি স্তরের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণী, দাখিল স্তরের ৮ম ও ৯ শ্রেণী এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল স্তরে ১০ কোটি ৭২ লাখ ৪০ হাজার ২৪৮ কপি, মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন) স্তরের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী ইবতেদায়ি স্তরের ১ম ও ২য় শ্রেণী দাখিল স্তরের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীর এবং কারিগরি (ট্রেড) স্তরে ১১ কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৫ কপি, মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন) স্তরের ৮ম ও ৯ম শ্রেণী ইবতেদায়ি স্তরের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণী, দাখিল স্তরের ৮ম ও ৯ম শ্রেণী এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল স্তরের ১০ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৮ কপি, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের ব্রেইল পুস্তক ৮ হাজার ৫৪ টি কপিসহ মোট ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৬ কপি বইয়ের জন্য মোট ৬শ ৭৬ কোটি ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৬৩৪ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণের যে কর্মসূচী হাতে নিয়েছে, তা এবার ৪০০ কোটির ঘর ছাড়াতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি দাঁড়াচ্ছে ৪০০ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯১১টি। ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বই বিতরণ করা হয়েছিল ৩৬৫ কোটি ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮১টি।

আরো পড়ুন  

×