ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

চাকমা লোককাহিনী নির্ভর গঙ্গা মা নাটকের মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ৪ অক্টোবর ২০২১

চাকমা লোককাহিনী নির্ভর গঙ্গা মা নাটকের মঞ্চায়ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাহাড়ী জনপদজুড়ে ছড়িয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা। সেখানকার নিসর্গের মতোই রঙিন সেই জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আর বৈচিত্র্যময় সেই সংস্কৃতির দেখা মিলল শহর ঢাকায়। রাজধানীর নাট্যপ্রেমীরা উপভোগ করলেন রাঙ্গামাটির হিল রেবিং থিয়েটারের নাটক। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হলো চাকমা লোককাহিনী অবলম্বনে নির্মিত নাটক গঙ্গা মা। আশিক সুমন রচিত ও নির্দেশিত প্রযোজনাটি চাকমা ভাষায় অনুবাদ করেছেন সুগত চাকমা। গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের তৃতীয় দিন রবিবার সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে নির্দেশক আশিক সুমন বলেন, চাকমা লোককাহিনীর এক সমৃদ্ধ প্লট নিয়ে নির্মিত নাটক ‘গঙ্গা মা’। মিথ আর বাস্তব জীবনের মিশেলে নির্মিত হয়েছে নাটকটির পটভূমি। যা দর্শককে নিয়ে যায় লৌকিক অলৌকিকের এক কল্পলোকে। এখানেই নাটকটির স্বকীয়তা। নাটকটিতে বর্ণনাত্মক নাট্য অভিনয়রীতির প্রয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি দর্শকের সঙ্গে মঞ্চশিল্পীদের সংযোগ স্থাপনে বাচিক অভিনয়ের সঙ্গে আঙ্গিক অভিনয়ের উপস্থাপন করা হয়েছে। নাটকের গল্পে আবির্ভূত হয় বহু বছর আগে চাকমা জনপদের এক বাসিন্দা। তার ছিল দুই কন্যা। একজন মনানি আরেকজন কুম্বলিনি। সংসারের এমন কোন কাজ নেই যা তাদের বাবা তাদের শিক্ষা দেয়নি। পুবাকাশে সূর্য ওঠার আগেই তারা ছোট্ট এক পানসী নাও বেয়ে চলে যায় দূর নদীতে। সারাদিন তারা কাজ করে। ফাল্গুন মাসের শেষে চৈত্র মাসে তারা চলে যায় জুমে। নতুন করে জমি তৈরি করে জুম চাষের জন্য। খরতাপে পুড়ে যায় তাদের শরীরের চামড়া। তবুও তারা কাজ করে যায় বিরামহীন। এমনই এক প্রখর রোদের দিনে মনানি তার ছোট বোনকে বলে- জুমে যদি একটা মোনঘর (বিশ্রামঘর) থাকত, তাহলে কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নেয়া যেত। আবেগের বশে মনানি এও বলে, কেউ যদি একটা মোনঘর তৈরি করে দিত তাহলে তাকে সে বিয়ে করত। নিজের স্বামী বলে মেনে নিত। এদিকে পাহাড়ী জনপদে এক ধনী লোক ত্রিজীবন মনানিকে বিয়ে করতে চায়। যদিও তার ঘরে আরও দুটি বউ আছে। তবে মনানির বাবা-মা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তারপরও মনানিকে বিয়ে করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে ত্রিজীবন। উদ্ভূত সেই পরিস্থিতির মাঝে এক রাতের মধ্যে কে যেন জুমে সুন্দর কারুকার্যময় এক মোনঘর তৈরি করে রাখে। বিস্ময়ে বিভোর মনানি আর কুম্বলিনি স্তব্ধ হয়ে যায়। কোথা থেকে এলো এই মোনঘর? এখন কি হবে? প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মনানিকে যে এই মোনঘরের মালিককে বিয়ে করতে হবে! স্বামী বলে মেনে নিতে হবে! ঘটনাক্রমে সেখানে ঝোপঝাড়ের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসে এক বিরাটাকৃতির সাপ। এই সাপই এই সুদৃশ্য মোনঘর তৈরি করেছে। পূর্বের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মনানি আকাশ-বাতাসকে সাক্ষী রেখে সেই সাপকেই তার স্বামী বলে মেনে নেয়। কিন্তু অদৃষ্টের কথা কে জানে? এই সাপ তো আসলে সাপ নয়, এ যে সর্পরূপী এক দেবতা! স্বর্গ থেকে বিতাড়িত অভিশপ্ত এক দেবতা। যদি এই দেবতা পৃথিবীতে কোন মনুষ্য কন্যাকে বিয়ে করতে পারে আর বিয়ের পর দুটি পূর্ণিমা পার করতে পারে তাহলে সে চিরকালের জন্য অভিশাপমুক্ত হয়ে যাবে। এক পূর্ণিমার রাতে সেই সর্পদেবতা মনানিকে সব কথা বলে দেয়। আর এও বলে মনানি যদি এই কথা কাউকে বলে তাহলে চিরদিনই তাকে অভিশপ্ত হয়ে এই পৃথিবীতে সর্পরূপে ঘুরে বেড়াতে হবে। সর্পদেবতার কাছে মনানি প্রতিজ্ঞা করে একথা সে কাউকেই বলবে না। অন্যদিকে কুম্বলিনি ভেবে পায় না তার বোন মনানি কি করে সাপের সঙ্গে ঘর করে! তার মনে সন্দেহ জাগে- একি সত্যি তার বোন নাকি তার বোনের রূপ ধরা অন্য কেউ? একদিন সব কথা তাদের বাবার কানে পৌঁছায়। তার বাবা সব কথা শুনে ভয় পায়। যে কোনভাবে সে পরিত্রাণ চায়। তাগল (দা) তুলে নেয় হাতে। নির্মম হিংস্র হয়ে উঠে সে। কুম্বলিনি আর তার বাবা-মা আদৌ জানল না সেই সর্পদেবতার কথা। তাদের মেয়ে মনানি যে সাপকে নয় এক দেবতাকে বিয়ে করেছে। আর সেই দেবতার বরে তাদের মেয়ে একদিন দেবী হবে! আর মাত্র একটি পূর্ণিমা বাকি! কিন্তু তার আগেই অনিষ্ট হলো অজান্তেই। সর্পদেবতার আর হলো না অভিশাপমুক্ত হওয়া! তবুও দেবতার বর সত্যি হলো। দেবী হলো মনানি। সত্য যুগের অদৃষ্টের খেলায় চোখের জলে ডুবে মনানি উত্তাল হয়ে বয়ে চলল। দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে বয়ে চলল দেবী গঙ্গারূপে। আর এভাবেই আবির্ভূত হলো অতৃপ্ত নীল গঙ্গা মা! প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে রূপ দিয়েছেন এলি চাকমা, মনিষা চাকমা, রিয়া চাকমা, রিশা চাকমা, নিকেল চাকমা, মেরী চাকমা, সুশান্ত চাকমা ও জিটন চাকমা।
×