শঙ্কর কুমার দে ॥ করোনা সংক্রমণের মধ্যেই বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের জঙ্গীরা সংগঠিত হচ্ছে অভিন্ন মতাদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশে। ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’-হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা জিহাদ করার উদ্দেশে সংগঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের জঙ্গীরা। একজোট হয়ে জঙ্গী তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত দুই জঙ্গী সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং ভারতের জামাতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া-জেএমআই। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে গেছে বড় মাপের তিন জঙ্গী-এমন খবরের ভিত্তিতে ভারতের কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স- এসটিএফকে জানায়, বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। বাংলাদেশ পুলিশের সিটিটিসির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গে ওই তিন জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স-এসটিএফ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের গ্রেফতার হওয়া তিন জঙ্গীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স-এসটিএফ, গোয়েন্দা সংস্থা ও বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
ভারতের কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া তিন জঙ্গীর মধ্যে নজিউর ওরফে জোসেফ বিজিবির বরখাস্ত সদস্য। বাংলাদেশের কাশিমপুর জেলে বন্দী হুজি জঙ্গী আল আমিন সম্পর্কে নজিউরের ভায়রা। মগজ ধোলাইয়ের পর নজিউর জেএমবির অনুগামী হয়ে পড়ে। বিজিবি থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর চলে যায় কলকাতায়। পরিচয় গোপন করে বাড়ি ভাড়া নেয়। গ্রেফতার হওয়া জেএমবির তিন জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদে এমনটাই জানতে পেরেছে কলকাতার এসটিএফ (স্পেশাল টাস্ক ফোর্স)।
একসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ১৫ জন জেএমবি জঙ্গী কলকাতায় গিয়েছিল। তারা ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। এসটিএফ সূত্রে খবর, কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশ্যায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকিরা জম্মু-কাশ্মীরের পথে গেছে। নজিউর রহমান ওরফে জোসেফ, মিকাইল খান ওরফে শেখ সাবির এবং রবিউল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের কারণে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি জঙ্গীদের থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থের জোগান দিতো জামাতের রবারি উইং বা ডাকাতি শাখা। যার প্রধান হুজি লিডার আল আমিন।
স্লিপার সেল তৈরির জন্য কলকাতায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক, বড় গয়নার শো-রুমে ডাকাতির পরিকল্পনা ছিল ধৃত জঙ্গীদের। ঘটনায় যুক্ত সেলিম মুন্সি নামে এক ব্যক্তিকে খুঁজছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের ২৬ জুলাই পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আদালত। আদালতের নির্দেশে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স-এসটিএফ ও গোয়েন্দারা। দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়েছে। এই তিনজনই বাংলাদেশের বাসিন্দা। আটককৃতরা হলেন, নাজিউর রহমান, সাবির এবং রবিউল ইসলাম। এদের কাছ থেকে অস্ত্র, বাংলাদেশী পাসপোর্ট, জিহাদী ও জঙ্গী সম্পর্কিত বিভিন্ন গোপন নথি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে এসটিএফ। সূত্রে খবর, বেশ কয়েকমাস ধরেই হরিদেবপুর এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে তারা বসবাস করছিল। তারা কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি রোগীর আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে আসছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এসটিএফ তল্লাশি অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করার পর আসল রহস্য উন্মোচন হয়। তাদের জেরা করে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন কলকাতা শহরের বুকে বসে দীর্ঘদিন ধরেই তারা সন্দেহভাজন কাজকর্ম চালাচ্ছিল। এই তিনজনই স্লিপার সেলের সদস্য বলে মনে করছে পুলিশ। আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে আর কারা যুক্ত রয়েছে তাও জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, ৭ বছর আগে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে বর্ধমান জেলার খাগড়াগড় বিস্ফোরণে ২ ব্যক্তির পরই এ রাজ্যে জেএমবি জঙ্গী যোগের বিষয়টি সামনে আসে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় রাজ্যের পাশাপাশি দেশের একাধিক এলাকা থেকে জেএমবি জঙ্গী গ্রেফতারের ঘটনা সামনে আসে। এরপর ভারতের লখেœৗতে অভিযান চালিয়ে ২ সন্দেহভাজন আল-কায়েদা জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে এ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড (এটিএস)। লখেœৗয়ের কাকোরি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই দুই সন্দেহভাজন আল-কায়েদা জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। কাকোরি এলাকায় শাহিদ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিল ওই দুই জঙ্গী। এরপরই সেখানে অভিযান চালানো হয়। বাড়ি থেকে দুইটি প্রেসার-কুকার বোম, একটি ডিটোনেটর, ৬ কেজি বিস্ফোরক পদার্থ উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মোহাঃ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, সম্প্রতি ভারতে বড় মাপের তিন জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। এ ধরনের তথ্য আমরা আদান-প্রদান করে থাকি। ওই তিনজন জিহাদের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে। তথ্যটা আমরা জানতাম, যা যথাযথ সময়েই ভারতকে জানিয়েছিলাম।
বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি জঙ্গীবাদ দমনে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে এ অপতৎপরতা বন্ধে একসঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ-ভারত গোয়েন্দারা। ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গের ওই চার জঙ্গীকে গ্রেফতার করে কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স-এসটিএফ। সম্প্রতি জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধি ও জঙ্গীদের সক্ষমতা বেড়েছে জানিয়ে ঢাকার শীর্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরাও কিন্তু বসে নেই। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে আমাদের যারা কাজ করছে তারা খুব এক্সপার্ট। ঘটনা ঘটার আগেই আমরা তথ্য পাচ্ছি। যেখানে যতটুকু পাচ্ছি, সেখানেই কাজ করছি। ঈদ-উল-আজহার আগে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা ও বন্দর উপজেলায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গীদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন বলে ওই কর্মকর্তার দাবি।
‘গাজওয়াতুল হিন্দ’- এর ডকুমেন্টস উদ্ধার ॥ রাজধানী ঢাকার মগবাজার, ইস্কাটন ও রাজাবাজার এলাকায় কয়েকটি সিরিয়াল ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জঙ্গী সম্পৃক্ততা পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় বেশ কয়েকজন জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় শীর্ষ এক জঙ্গী নেতার মোবাইল ফোন। সেই মোবাইল ফোন থেকেই ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’-এর জন্য বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের একজোট হয়ে কাজ করা সম্পর্কিত কিছু নথি উদ্ধার হয়। সেসব কাগজপত্রে কীভাবে একজোট হয়ে কাজ করা হবে তা নিয়ে কয়েক পাতার একটি নির্দেশিকা ছিল। মোবাইল ফোনটি যে শীর্ষ জঙ্গী ব্যবহার করত, তার নাম আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয়। যাকে ‘হিন্দ অঞ্চল’-এর সামরিক শাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পলাতক এই শীর্ষ জঙ্গীর সঙ্গে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে থাকা জঙ্গীদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, তেমনি সে মাঝেমধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে নিয়মিত ভারতে যাতায়াত করত। ভারতের স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত কাশ্মীরে গিয়ে জঙ্গীবাদের সামরিক প্রশিক্ষণও নিয়েছে আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয়।
কি সেই গাজওয়াতুল হিন্দ মতাদর্শ ॥ গাজওয়াতুল হিন্দ হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী। এতে বলা হয়েছে, হিন্দুস্তানে (ভারতীয় উপমহাদেশ) অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলিমদের একটি যুদ্ধ হবে। এই যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করবেন। ধর্মবিদ ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। তারপরও নতুন করে গাজওয়াতুল হিন্দ মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে সংগঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের জঙ্গীরা।
কথপোকথনের রেকর্ড ॥ শীর্ষ জঙ্গী আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয়ের অনেকগুলো কথপোকথনের রেকর্ড পেয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স-এসটিএফ পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের বরাত দিয়ে বলেছে, বারাসাত থেকে লালু সেন বা রাহুল নামে যাকে তারা গ্রেফতার করেছে, গ্রেফতারের আগে তার বাসায় এই আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয় অবস্থান করেছিল। রাহুলের বাসা থেকে এসটিএফ হৃদয়ের ব্যবহার করা কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসও উদ্ধার করেছে।
জঙ্গী আল-আমিনের স্বীকারোক্তি ॥ জঙ্গী আল-আমীন গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, সে আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য। আগেও একবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর খুলনার বাসিন্দা আল-আমীন গোপালগঞ্জে গিয়ে অবস্থান করে। কয়েকমাস পর আবারও তাকে র্যাব গ্রেফতার করে। বাংলাদেশে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল-ইসলামের সঙ্গে একজোট হয়ে গাজওয়াতুল হিন্দ মতাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসির একজন বলেছেন, অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গীরা ভারতে গিয়ে সংগঠনের কাজ করছে। ভারতে এখন তাদের প্রচুর ‘ভাই’ (জঙ্গী সদস্য) তৈরি হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। এছাড়া পেশাদার অপরাধী চক্রের সঙ্গে মিশেও ডাকাতি করছে তারা। এতে যে অর্থ আসে, তা পাঁচভাগ করে দুইভাগ সংগঠনের তহবিলে এবং তিনভাগ সদস্যরা নিজেরা খরচ করে। জঙ্গীরা এখন স্লিপার সেল পদ্ধতিতে সংগঠিত হচ্ছে। একটি স্লিপার সেলের সদস্যরা আরেকটি স্লিপার সেলের তথ্য জানে না। শীর্ষ নেতারা সরাসরি স্লিপার সেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। রেজাউলের কাছ থেকে আমরা সালাউদ্দিন সালেহীনের বিষয়ে কিছু তথ্য পেয়েছি। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড সালাউদ্দিন সালেহীনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিটিটিসি কর্মকর্তা।