
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের আকাশে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের নাম— এয়ারবাস A380। ডাবল ডেক ডিজাইন, আধুনিক প্রযুক্তি আর আরামদায়ক অভ্যন্তরীণ বিন্যাসের কারণে এটি দীর্ঘদিন ধরেই বিমানপ্রেমীদের কৌতূহল ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
১৯৮০’র দশকের শেষভাগে এয়ারবাসের প্রকৌশলীরা চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে এমন একটি বিশাল যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ তৈরি করা যায়, যা বোয়িং 747-কে টেক্কা দিতে পারে। সে সময় দূরপাল্লার বাণিজ্যিক উড়ান বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল বোয়িংয়ের। সেই পরিস্থিতিতে এয়ারবাসের লক্ষ্য ছিল— এমন একটি বিমান তৈরি করা, যা বেশি যাত্রী বহন করতে পারবে, আবার প্রতি আসনের জন্য জ্বালানি খরচও হবে তুলনামূলকভাবে কম। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় A380 প্রকল্প, যার প্রাথমিক নাম ছিল “A3X”।
A380 একটি সম্পূর্ণ ডাবল ডেক উড়োজাহাজ— অর্থাৎ এটি দুই তলার। তিন শ্রেণীর আসন বিন্যাসে এটি গড়ে ৫২৫ জন যাত্রী বহন করতে পারে, আর সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৮৫৩ জন। বিশাল আকারের এই বিমানটির দৈর্ঘ্য ২৩৮ ফুট, যা একে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের মর্যাদা দিয়েছে।
এটিকে আকাশে ভাসিয়ে রাখে চারটি শক্তিশালী টার্বোফ্যান ইঞ্জিন— রোলস রয়েস ট্রেন্ট 900 অথবা ইঞ্জিন অ্যালায়েন্স জিপি7200। একটানা প্রায় ১৪,৮০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার ক্ষমতা রয়েছে এই বিমানের।
যাত্রীসেবার মানে অতুলনীয় হওয়ার পেছনে রয়েছে উন্নত এরোডাইনামিক ডিজাইন, আধুনিক কেবিন প্রেসার প্রযুক্তি, শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং প্রশস্ত জানালা ও আসনের মাঝখানের পর্যাপ্ত জায়গা। সব মিলিয়ে এটি যাত্রীদের কাছে একটি আরামদায়ক ‘উড়ন্ত লিভিং রুম’ হয়ে ওঠে।
এত বিশাল ও জটিল প্রকল্প বাস্তবায়নে এয়ারবাসকে পড়তে হয়েছে বহু চড়াই-উৎরাইয়ের মুখে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয় প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন দেশে আলাদা ডিজাইন ও সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে সরবরাহে বিলম্ব হয়, বৈদ্যুতিক সিস্টেমেও দেখা দেয় জটিলতা— যার প্রভাব পড়ে উৎপাদন ব্যয়ে।
২০০৫ সালে প্রথমবার A380 আকাশে ওড়ে, আর ২০০৭ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়।
যদিও যাত্রীদের কাছে এটি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেয়, তবে এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য এত বড় উড়োজাহাজ চালানো খুব সহজ ছিল না। এর জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ রানওয়ে, বড় গেট ও চেট ব্রিজ, যা সব এয়ারপোর্টে নেই। এছাড়া যাত্রী সংখ্যা সব রুটে পর্যাপ্ত না থাকলে বিমানটি চালানো আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
আরও বড় সমস্যা তৈরি করে এয়ার ট্র্যাভেলের নতুন ধারা— সরাসরি পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট গন্তব্যে যাত্রা। যেখানে কম যাত্রী নিয়েও ছোট ইঞ্জিনের উড়োজাহাজ— যেমন বোয়িং ৭৮৭ ও এয়ারবাস A350— বেশি লাভজনক।
এইসব কারণে ২০২১ সালের পর A380-এর উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয় এয়ারবাস।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে ২৫১টি A380 সচল রয়েছে। এমিরেটস, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সসহ বেশ কিছু নামকরা সংস্থা এখনও এটি ব্যবহার করছে। বিশেষ করে দূরপাল্লার ফ্লাইটে যাত্রীদের কাছে এই বিমানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। অনেক এয়ারলাইনে A380-তে রয়েছে বিলাসবহুল প্রাইভেট স্যুট, ইনফ্লাইট লাউঞ্জ, স্পা ও বার— যা একে অন্য যেকোনো বিমানের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।
বিশাল আকার, অতুলনীয় আরাম এবং সর্বোচ্চ যাত্রীবহনের ক্ষমতার কারণে A380 বিমানটি একটি উড়ন্ত শহর হিসেবেই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। উৎপাদন বন্ধ হলেও এ বিমান বহু বছর ধরে আকাশে উড়বে এবং তার অনন্যত্ব বজায় রাখবে।
এসএফ