
বিমান তৈরির জন্য একটি সাধারণ কারখানা যথেষ্ট নয়—এর জন্য দরকার বিশাল পরিসরের এক কর্মযজ্ঞ। এমনই এক দানবীয় কারখানার কথা বলছি, যেটি শুধু আকারে বড় নয়, বরং এর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে আছে মানুষের সৃজনশীলতা, প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনী শক্তির গল্প।
১৯৬০-এর দশকে বোয়িং যখন ৪০০ যাত্রীবাহী এক অতিকায় বিমানের পরিকল্পনা নেয়, যেটি পরে বোয়িং ৭৪৭ নামে পরিচিত হয়, তখন বোঝা গিয়েছিল এই 'জাম্বোজেট' নির্মাণে প্রয়োজন হবে এক বিশাল ফ্যাক্টরির। বোয়িং কোম্পানি সেই সময় খুঁজতে থাকে এমন একটি জায়গা, যেখানে একসঙ্গে বহু বিমান তৈরি করা যাবে। তাদের চোখ পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে এভারেট শহরের এক পুরনো সামরিক বিমানঘাঁটির উপর।
সেই নির্জন জায়গায় ১৯৬৭ সালে মাত্র এক বছরের মধ্যেই গড়ে ওঠে এক বিস্ময়কর শিল্প স্থাপনা—এভারেট ফ্যাক্টরি। এই ভবন আজ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন। এর আয়তন ৪৭২ মিলিয়ন কিউবিক ফুট, যেখানে গোটা ডিজনিল্যান্ড ঢুকিয়ে দিলেও অতিরিক্ত ১২ একর জায়গা খালি থাকবে।
এভারেট ফ্যাক্টরি শুধু বিমানের জন্য নয়—এটি যেন এক নিজস্ব শহর। এখানে রয়েছে নিজস্ব ফায়ার স্টেশন, মেডিকেল ক্লিনিক, জিম, ডে কেয়ার সেন্টার, ব্যাংক, এমনকি পানি শোধনাগারও। প্রায় ৩৬ হাজার কর্মী তিনটি শিফটে কাজ করেন, আর তাদের চলাফেরার জন্য রয়েছে ১,৩০০ সাইকেল ও ট্রাইসাইকেল। কর্মীদের সুবিধার্থে রয়েছে ২.৩৩ ও ৩.৩ মাইল দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ টানেল, যা দ্রুত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে সাহায্য করে।
এই ফ্যাক্টরিতে বোয়িং ৭৪৭ ছাড়াও বোয়িং ৭৬৭, ৭৭৭, এবং ড্রিমলাইনার ৭৮৭ মডেলের প্রায় ৫ হাজারের বেশি বড় আকৃতির বিমান তৈরি হয়েছে। প্রতিটি বিমান ধীরে ধীরে একই প্রোডাকশন লাইনে অগ্রসর হয়—প্রতি মিনিটে মাত্র ১.৫ ইঞ্চি গতিতে। ২৬টি ওভারহেড ট্রেন বিশাল আকারের বিমানের যন্ত্রাংশগুলো স্থানান্তর করে প্রায় ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাক বরাবর।
ভবনের দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছয়টি বিশাল দরজা এবং পশ্চিমে চারটি, প্রতিটি ৮২ ফুট উঁচু ও ৩০০ ফুট প্রশস্ত। পূর্ব পাশে রয়েছে দুটি দরজা, যেগুলোর প্রস্থ ৩৫০ ফুট। একটি বোতামে চাপ দিলেই এই দরজাগুলো খুলে যায়, পুরোপুরি খুলতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট।
তবে এত বিশাল ভবনে কোনো এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা নেই। গ্রীষ্মে দরজা খুলে ফ্যানের মাধ্যমে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করানো হয়, আর শীতে ১০ লাখ ওভারহেড লাইটের তাপেই গরম রাখা হয় ভবনটি। ভবনের বিশালতা এতটাই যে এক সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে ছাদের নিচে মেঘ জমে! যদিও কর্তৃপক্ষ এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে।
প্রতিবছর হাজারো মানুষ এই ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে আসেন। রাষ্ট্রপ্রধান, সিইও, মহাকাশচারীসহ অনেক নামকরা ব্যক্তিত্বও এখানে এসে দেখেন কীভাবে কল্পনা, প্রযুক্তি এবং মানুষের নিষ্ঠা মিলিয়ে গড়ে ওঠে আকাশে ওড়ার জন্য তৈরি এই বিশাল বাহনগুলো।
এভারেট কারখানা শুধু একটি ইঞ্জিনিয়ারিং অর্জন নয়, এটি মানুষের সীমাহীন উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রতীক।
সূত্রঃ https://www.youtube.com/watch?v=TrG-FLFC4Dc
রাজু