ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ফেসবুকে অভিনব প্রতারণা, ৩০ লাখ টাকা আত্মসাত

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৭ মে ২০২১

ফেসবুকে অভিনব প্রতারণা, ৩০ লাখ টাকা আত্মসাত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওরা ভয়ঙ্কর প্রতারক। প্রথমে ওরা একটি ফেসবুক ট্রাভেলার গ্রুপের মাধ্যমে ভ্রমণে গিয়ে ভ্রমণপিপাসুর সঙ্গে পরিচয় করে। একপর্যায়ে বন্ধুত্ব থেকে ব্যবসায়ের প্রস্তাব দেয় তারা। সুযোগ বুঝে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নেয়। এরকমই একটি ফেসবুক ট্রাভেলার গ্রুপকেন্দ্রিক অভিনব প্রতারণার ফাঁদের পড়ে অনেকে কোটি কোটি খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। মঙ্গলবার রাতে ডিবির সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ কল্যাণপুর, আশুলিয়া ও চাঁদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে এরকম একটি ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্রের হোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, ‘লঞ্চ ভ্যাসেল ফাইন্ডার্স বাংলাদেশ’ নামে একটি ফেসবুক ট্রাভেলার গ্রুপের পরিচালক ও চক্রের হোতা জাকারিয়া (২৪), জাহিদ ইবনে জাহান (৩০) ও সোহরাব হোসেন টিটু (৩৮)। এ সময় তাদের ব্যবহৃত নামে-বেনামে ১৮টি ফেসবুক আইডি উদ্ধার করা হয়। ডিবি জানায়, ভুক্তভোগী এক যুবক প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা খুইয়েছেন এমন অভিযোগে গত ২৩ মে রামপুরা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করে। ডিবি পুলিশ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, হরেক নামে শত-শত ট্রাভেলার গ্রুপে প্রায় সারাক্ষণই চলে ভ্রমণ বিষয়ক আলোচনা, থাকে নানান দিক-নির্দেশনা। ইদানীং এসব গ্রুপভিত্তিক নানা ইভেন্ট খুলে পরিচিত-অপরিচিত মিলে ভ্রমণে যেতে দেখা যায় প্রায়শই। এই সুযোগ নিয়েই ‘লঞ্চ ভ্যাসেল ফাইন্ডার্স বাংলাদেশ’ নামে একটি ফেসবুক ট্রাভেলার গ্রুপ খুলে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পাতে চক্রটি। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নানা পন্থায় হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ভুক্তভোগী এক যুবককে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত বিপণন প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন, ইবের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসার প্রস্তাব দেন প্রতারক জাকারিয়াসহ তার সহযোগীরা। তারপরই ডোমেইন কেনানো, ওয়েবসাইট বানানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় ওই যুবকের। ডিবির সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফ উল্লাহ জানান, যত বেশি ডোমেইন তত বেশি মুনাফার প্রলোভন, একে একে ৪২টি ডোমেইন বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জাকারিয়া। ওয়েবসাইট হ্যাকের নামে, তা উদ্ধারের কথা বলে, কখনও আবার সিকিউরিটি ইন্সটলেশনের কথা বলেও টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জাকারিয়া নিজেই উন্নত ওয়েব ডিজাইনার, নিজেই হ্যাকার, আবার প্রতারণার প্রয়োজনে নিজেই আমেরিকান প্রবাসী কিংবা আইটি এক্সপার্ট সেজে কথা বলেন। বিনিয়োগের মুনাফা দেয়ার সময় এলেই জাকারিয়াসহ তার সহযোগীরা শুরু করতেন টালবাহানা। এমনকি ভুক্তভোগীর মেয়ের ছবি যুক্ত করে ওয়েবসাইটে পর্নো ছেড়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে নানা পন্থায় ভুক্তভোগী এক যুবকের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে ওই যুবক গত ২৩ মে রামপুরা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বিবরণে জানা যায়, ভুক্তভোগী মনপুরা ভ্রমণে গিয়ে প্রতারক জাকারিয়ার সঙ্গে পরিচয়ের একপর্যায়ে ভাল সম্পর্ক হয়। এরপর তারা একসঙ্গে চাঁদপুর-বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে যান। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার সুযোগে একসময় ভুক্তভোগী ওই যুবককে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত বিপণন প্রতিষ্ঠান অ্যামাজান, ইবের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসার প্রস্তাব দেয়া হয়। ভুক্তভোগী রাজি হলে ডোমেইন কেনা, ওয়েবসাইট বানানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন জাকারিয়া। যত বেশি ডোমেইন তত বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে একে একে ৪২টি ডোমেইনের টাকা নেয়া হয়। ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছে, উদ্ধার করতে কিংবা সিকিউরিটির কথা বলে নেয়াও হয়েছে টাকা। আমেরিকা থেকে উন্নত ওয়েবসাইট বানানোর কথা বলেও টাকা আদায় করা হয়। এক্ষেত্রে নিজেই বিভিন্ন নামে ফেসবুক আইডি খুলে ভুক্তভোগীর সঙ্গে কখনও হ্যাকার সেজে, কখনও আমেরিকান প্রবাসী কিংবা আইটি এক্সপার্ট সেজে কথা বলেছেন জাকারিয়া। বিনিয়োগের মুনাফা দেয়ার সময় এলেই জাকারিয়াসহ তার সঙ্গীরা শুরু করতেন টালবাহানা। এমনকি ভুক্তভোগীর মেয়ের ছবি যুক্ত করে ওয়েবসাইটে পর্নো ছেড়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে নানা পন্থায় ভুক্তভোগী যুবকের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। এদিকে প্রায় একইভাবে জাকারিয়ার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে টাকা খোয়ান জোবায়ের হোসেন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, লঞ্চ ভ্যাসেল ফাইন্ডার্স বাংলাদেশ গ্রুপের মাধ্যমে ভ্রমণে গিয়ে জাকারিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই ওই ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে ট্যুরগুলো পরিচালনা করতেন। পরিচয় থেকে ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের একপর্যায়ে অ্যামাজনের সঙ্গে এ্যাফিলিয়েট ব্যবসার প্রস্তাব দেন তিনি। এখানে বিনিয়োগ করলে ভালো লাভ হবে এবং এজন্য একটা ওয়েবসাইট বানাতে হবে বলে জানান। ওই শিক্ষার্থী জানান, প্রথমে এক লাখ এবং পরে আরও দুই লাখ টাকা দেই। টিউশানির জমানো টাকা এবং বাবার কাছ থেকে কিছু নিয়ে তাকে দেই। টাকা দেয়ার পর লভ্যাংশ আর দেয় না। নানাভাবে ঘোরাতে থাকে। যখন প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারি, ততক্ষণে টাকা হাত ছাড়া। যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। রাসেল নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, গ্রুপটি সাধারণত নৌযান কেন্দ্রিক ভ্রমণ পরিচালনা করে। এই গ্রুপের মাধ্যমে ভ্রমণে যাওয়ার সুবাদে অ্যাডমিনের সঙ্গে পরিচয়। একপর্যায়ে এ্যাডমিন তার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে মায়ের চিকিৎসার কথা বলে কিছু টাকা ধার চান। আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে বিকাশে ১৬ হাজার টাকা পাঠাই। পরে টাকা চাইতে গেলেই আমার সঙ্গে বাজে আচরণসহ নানা ভয়ভীতি দেখানো শুরু করে। একইভাবে প্রতারিত হয়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা খুইয়েছেন রমজান আলী। তিনি জানান, তাদের পণ্য বিক্রিতে নাকি অনেক লাভ। এক রকম শেয়ারিং ব্যবসার জন্য তাকে ৩ লাখ টাকা দেই। এরপর একদিন আবার জরুরী দরকার বলে ৩০ হাজার টাকা ধার নেয়। এরপর যখনই যোগাযোগ করা তখনই খারাপ আচরণ, হুমকি-ধমকি। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা উত্তর ও সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। শুধুমাত্র একজনের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ পেয়েছি। তাদের গ্রেফতারের খবরে অনেকেই ডিবি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, ব্যবসায়ে ওয়েবসাইট বানানোর নামে প্রথমে টাকা হাতিয়ে নিতো চক্রটি। তারপর নির্দিষ্ট সময় পর পর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মুনাফার কিছু টাকাও ফেরত দেয়া হতো। এভাবে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। গ্রেফতারদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
×