
দেশ যখন করোনাভাইরাস এবং ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই রাজধানী ঢাকায় নতুন করে দেখা দিয়েছে আরও একটি মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া। জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ভাইরাসের পুনরাবির্ভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মে পর্যন্ত সারাদেশে সন্দেহভাজন ৩৩৭টি চিকুনগুনিয়া রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৩ জন রোগীর দেহে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। হঠাৎ জ্বর, প্রচণ্ড অস্থিসন্ধি ব্যথা, মাথাব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা এবং শরীরে র্যাশ বা লালচে দাগ চিকুনগুনিয়ার সাধারণ উপসর্গ। যেহেতু ডেঙ্গু ও করোনার সংক্রমণ ইতোমধ্যে বাড়ছে, সেক্ষেত্রে নতুন করে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার স্বাস্থ্যসেবায় বড় ধরনের চাপ ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের জুন মাসের শুরুতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সন্দেহভাজন ও নিশ্চিত রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, যা শহরাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকায় সংক্রমণ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা থেকে চিকুনগুনিয়া রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে। আক্রান্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে মোহাখালী, তেজগাঁও, নাখালপাড়া, খিলখেত, নিকেতন, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরা, লালবাগ, আজিমপুর, হাজারীবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, খিলগাঁও, মুগদা, গোরান, রামপুরা ও শাহজাহানপুর।
চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে কোনও জাতীয় পর্যায়ের নিয়মিত নজরদারি ব্যবস্থা না থাকায়, পরীক্ষার সীমিত সুযোগ এবং ডেঙ্গুর সঙ্গে উপসর্গের মিলের কারণে প্রকৃত সংক্রমণের পরিমাণ রিপোর্টকৃত সংখ্যার চেয়েও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঈদের ছুটিতে হাজার হাজার মানুষ ঢাকার বাইরে যাতায়াত করেছে, যার ফলে এই রোগ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলেও সতর্ক করেছে আইইডিসিআর।
প্রতিষ্ঠানটি চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ চিহ্নিত করতে চিকিৎসকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে, নতুন হটস্পট শনাক্তে নজরদারি জোরদার করতে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে তাগিদ দিয়েছে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে কিছু রোগী পাওয়া যায়। তবে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যেখানে ঢাকাসহ আরও ১৬টি জেলা আক্রান্ত হয়েছিল।
চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাস এই তিনটি রোগই এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এগুলোর উপসর্গ প্রায় একই রকম। সাধারণত পরিস্কার, স্থির পানিতে এই মশার প্রজনন হয়, ফলে এসব এলাকার বাসিন্দারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, “এ ধরনের রোগ সাধারণত নির্দিষ্ট ব্যবধানের পর আবারও ফিরে আসে। গত বছর অক্টোবরে কয়েকটি মাত্র রোগীর খোঁজ মিলেছিল, এবার সংখ্যাটা অনেক বেশি। প্রবণতা বলছে, সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এইচ এম নাজমুল আহসান জানান, “করোনার ক্ষেত্রে সাধারণত ঘ্রাণশক্তি হারানো ও হালকা ডায়রিয়া দেখা যায়। তবে জ্বরের সঙ্গে সর্দি না থাকলে সেটা ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “চিকুনগুনিয়ার বেশিরভাগ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় না, তাই অনেক ক্ষেত্রেই তা শনাক্ত হয় না।”
তার ভাষ্য অনুযায়ী, চিকুনগুনিয়ায় অস্থিসন্ধিতে এমন ব্যথা হয় যা এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং রোগী হাঁটতে পর্যন্ত পারেন না। অন্যদিকে, ডেঙ্গুতে সাধারণত পেশিতে ব্যথা হয় যা সাত দিনের মধ্যে কমে আসে।
এ রোগের পরীক্ষার ব্যবস্থা এখনো সীমিত হওয়ায়, অনেকে যখন ডেঙ্গু পরীক্ষায় নেগেটিভ হন, তখন কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। উপসর্গ থেকে গেলে চিকুনগুনিয়া ধরে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
নাজমুল আহসান বলেন, “জ্বর হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং শরীরে পানির ঘাটতি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ডাবের পানি, ওরাল স্যালাইন এবং ফলের রস উপকারে আসবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, “দেশে একটি কার্যকর স্তরভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা জরুরি, যেখানে স্পষ্টভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় স্তরের চিকিৎসাসেবা থাকবে।”
তিনি বলেন, “উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়া এইসব রোগের দ্রুত সনাক্তকরণ সম্ভব নয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষা করাতে পারেন না, ফলে রোগ ধরা পড়ে দেরিতে।”
তার প্রস্তাব, দেশের বিভিন্ন এলাকায় রক্ত সংগ্রহ কেন্দ্র ও মাধ্যমিক চিকিৎসাকেন্দ্র বাড়াতে হবে, যাতে মেডিকেল কলেজগুলো শুধু গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় মনোনিবেশ করতে পারে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, চিকুনগুনিয়ার কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। রোগীকে বিশ্রাম নিতে বলা হয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হয়।
ডেঙ্গু, করোনাভাইরাসের পাশাপাশি এখন রাজধানীতে ফের দেখা দিচ্ছে চিকুনগুনিয়া। শহরের একাধিক এলাকায় ব্যাপক সংক্রমণ দেখা যাওয়ায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নতুন করে চাপ পড়তে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় থাকতে সজাগ না হলে এবং নজরদারি জোরদার না করলে আবারও সামনে বড় সংকট দেখা দিতে পারে।
সূত্র:https://tinyurl.com/3njh32fb
আফরোজা