শংকর কুমার দে ॥ প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার আনন্দ বিনোদনের জন্য ছায়া হয়ে সঙ্গী ছিলেন দুই বান্ধবী। এই দুই বান্ধবীর একজনের নাম অবন্তিকা বড়াল ও অপর বান্ধবীর নাম নাহিদা রুনাই। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর জন্য পৃথকভাবে দুই বান্ধবীকে নিয়ে পিকে হালদার কেবলমাত্র সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডই ভ্রমণ করেছেন ২৫ বার। সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ছাড়াও দেশ-বিদেশে কত আনন্দ ভ্রমণ করেছেন তার হিসাব মেলানোটাই দুষ্কর। কেবলমাত্র আনন্দ বিনোদন দিয়েই দুই বান্ধবী শত কোটি টাকার মালিক। দেশের আর্থিক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পিকে হালদারের দুই বান্ধবী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পিকে হালদারের সহযোগী পিপলস লিজিং’র চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দী। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের আদালতে। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে বের হয়ে এসেছে পিকে হালদারের সঙ্গে দুই বান্ধবীর বেপরোয়া প্রেম-ভালবাসা, অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানো, আনন্দ বিনোদন ভ্রমণ কাহিনী। অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল অর্থ বিত্ত বৈভবের মালিক পিকে হালদার। পিকে হালদারকে শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ করে রাখতেন অবন্তিকা ও রুনাই। পিকে হালদারকে একান্তে নিজ বাহুডোরে বেঁধে রাখার জন্য দুই বান্ধবীর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনার বিবরণও পাওয়া গেছে উজ্জল কুমার নন্দির জবানবন্দীতে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পিকে হালদার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার বিদায় বেলায়ও ছায়া হয়ে কাছে ছিলেন দুই বান্ধবী অবন্তিকা ও রুনাই। দুই জনেই লম্বা, ফর্সা, আকর্ষণীয় চেহারার তরুণী। দুই বান্ধবীই পাশাপাশি বসে বিদায় জানিয়েছেন পিকে হালদারকে। কথা বলতে বলতে অবন্তিকার হাতের ছোঁয়া লাগছে হালদারের হাতে। দু’জনের চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটির ঠোঁটে দেখা যায় মিষ্টি হাসির আভা। বিদায় বেলায় পিকে হালদারের মুখ বিষণ্ণ। বিষণ্ণতা কাটাতে আর কিছুটা আনন্দ দিতে চেষ্টা করেন অবন্তিকা নামের বান্ধবী। পিকে হালদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে মিষ্টি করে কিছু একটা বলেন অবন্তিকা।
হাজার কোটি টাকার মালিক পিকে হালদার। অর্থ বিত্ত ভোগ বিলাস ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশের অজানা গন্তব্যে। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটে গেল আরেক ঘটনা। পিকে হালদার ও অবন্তিকা দুই জনেই চমকে উঠলেন। তাদের সামনে আচমকা উপস্থিত আরেক তরুণী। এই তরুণীর নাম নাহিদা রুনাই। ওই মুহূর্তে অবন্তিকার হাত শক্ত করে ধরে আছেন পিকে হালদার। হালদারের সঙ্গে থাকা অবন্তিকার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকান রুনাই। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন। তারপর পিকে হালদারকে নিয়ে বাসায়। বাসায় যাওয়ার পর পিকে হালদারের সামনেই তুমুল ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন অবন্তিকা ও রুনাই। এমনকি পিকে হালদারের গায়ে হাত তোলেন নাহিদা রুনাই।
অবন্তিকা বড়ালকে নিয়ে বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন পিকে হালদার। কিন্তু সেবার আর যাওয়া হয়নি। দেশের আর্থিক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পিকে হালদারের দুই বান্ধবী। অর্থ বিত্ত বৈভবের মালিক পিকে হালদারকে কাছে পেতে মরিয়া ছিলেন দুই বান্ধবীই।
নিজেদের রূপ, যৌবন দিয়ে কাছে টেনে রাখতে চাইতেন। এ নিয়ে অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইয়ের মধ্যে এক ধরনের যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু দুই বান্ধবীকেই একান্তে চাইতেন পিকে হালদার। একজনের অজান্তে অন্যজনকে নিয়ে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতেন। চলে যেতেন দেশের বাইরে। পিকে হালদারের সঙ্গে আলাদাভাবে প্রায় ২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন অবন্তিকা ও রুনাই।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে দেয়া তথ্য ও আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে জানা গেছে, দেশের আর্থিক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পলাতক এখন পিকে হালদার। কিন্তু তার সহযোগীরা এখনও দেশে অবস্থান করছেন। এদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, আবার অনেকেই আত্মগোপনে আছেন। পিকে হালদারের প্রেম-ভালবাসা, অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানো, আনন্দ-বিনোদন ভ্রমণ ও বেপরোয়া জীবন যাপনের দুই বান্ধবীর মধ্যে অবন্তিকা বড়াল নামে এক বান্ধবীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পিকে হালদারকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে দুই বান্ধবীর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হতো। শুধু মাত্র পিকে হালদারের অর্থ বিত্ত আর বৈভবের টানে পিকে হালদারকে একান্তে কাছে টেনে রাখতেন দুই বান্ধবী।
পিকে হালদারের সহযোগী পিপলস লিজিং’র চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দী জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, উজ্জল কুমার নন্দীসহ পিকে হালদারের সহযোগীরা রুনাইকে বড় আপা এবং অবন্তিকাকে ছোট আপা বলে সম্বোধন করতেন। রুনাই চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আর অবন্তিকা চালাতেন পিপলস লিজিং। পিকে হালদারকে ব্যবহার করে অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে রুনাই। কয়েক বছরে তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭২ কোটি টাকার ট্রান্সজেকশন রয়েছে।
জবানবন্দীতে উজ্জল কুমার নন্দী বলেন, পিকে হালদার বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন দেশে প্রমোদের জন্য পাঠাতেন। সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে গিয়েছি দুই-তিনবার। তিন বার গিয়েছি মালয়েশিয়াতে। এরমধ্যে দু’বার পিকে হালদারের সঙ্গে। উজ্জল কুমার নন্দী জানান, মালয়েশিয়াতে তার সঙ্গে ছিলেন অমিতাভ অধিকারী, রাজীব সোম। মূলত, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ের বিষয়ে আলোচনার জন্য পিকে হালদারের সঙ্গে দু’বার মালয়েশিয়া যান উজ্জল। একবার ফ্যামিলি ট্যুরেও যান। প্রতিবারই ভ্রমণের সকল খরচ দিয়েছেন পিকে হালদার। এ সকল ভ্রমণে তার সঙ্গী হতেন রাজীব সোম, অমিতাভ অধিকারী ও অবন্তিকা বড়াল। এছাড়াও ভারতে গিয়েছেন সাত-আট বার।
উজ্জল কুমার নন্দী জবানবন্দীতে আরও জানান, পিকে হালদার ২০১৪ সালে ১২৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজার র্যাডিসন হোটেলটি ক্রয় করেন। পিকে হালদার রিলায়েন্স লিজিং থেকে বিভিন্নভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। পরে একই কায়দায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করে রিলায়েন্সের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেন। এই অপকর্মে উজ্জল কুমারকে সহযোগিতা করেন হালদারের বান্ধবী নাহিদা রুনাই, আল মামুন সোহাগ, রাফসান রিয়াদ চৌধুরীসহ অনেকে। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাই। তারপর থেকে পিকে হালদারের কথামতো ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক নওশেরুল ইসলাম, বাসুদেব ব্যানার্জীদের প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং ও এমটিবি মেরিনকে ঋণ দিই। প্রকৃতপক্ষে দিয়া শিপিং নামের কোন কোম্পানি নেই। ঋণের পুরো টাকাই এই দুই প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে এফএএস ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ হয়েছে। পরে জানতে পেরেছি, ১৫৮টি ফাইল আমার সময়ে গায়েব হয়েছে। এজন্য জবানবন্দীতে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন উজ্জল কুমার নন্দী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, পিকে হালদার দেশে থাকার সময়ে একদিন বসা ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে। ব্যাংকের ভেতরেই পিকে হালদারের সঙ্গে ঝগড়া করেন নাহিদা রুনাই। এমনকি রুনাই রাতের বেলায় পিকে হালদারের বাসায় গিয়ে তার রুমে ভাংচুর চালান। একদমই সহ্য করতে পারতেন না অবন্তিকাকে। কিন্তু অবন্তিকা ও রুনাই দুই জনকেই একান্ডে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কাছে পেতে চাইতেন পিকে হালদার। দুই বান্ধবীকে এক সঙ্গে সামাল দিতে পারতেন না। তাই পৃথকভাবে দুই বান্ধবীকে নিয়ে আনন্দ-বিনোদন ভ্রমণে বের হতেন বিদেশে। দেশের মধ্যেও অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কাটাতে বের হয়ে পড়তেন অভিসারে। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে যেতেন পিকে হালদার। কখনও তারকা হোটেলের কক্ষে ভাসতেন সুখের মোহনায়। স্বল্প পোশাকে বিচে বেড়াতে যাওয়া, গোসল করা, বারে ড্যান্স করা ছিল তার শখ।