
সমুদ্র হক ॥ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগে প্রথম বাঙালী নারী কবির আবির্ভাব এই বঙ্গীয় বদ্বীপে। যিনি কাব্য সাহিত্যে নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে নেয়ার পথ দেখিয়েছেন। কাব্যে, কল্পবিজ্ঞানে, সুদূরপ্রসারী ভাবনায় লিখেছেন, সূর্যের আলোকরশ্মি এগিয়ে নেবে বাঙালীকে। এই নারী কবির বর্ণাঢ্য জীবনের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে অগোচরেই রয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকে তার কথা জেনে ঘুরে এসেছেন কিশোরগঞ্জ। এমনই একজন পাবনার মেয়ে লিজা তাহমিনা। ইংরেজী সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রীধারী; তবে বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী। বর্তমানে স্বামীর চাকরিসূত্রে থাকেন চট্টগ্রামে। খুঁজে বের করেছেন মধ্যযুগের এই নারী কবির ঠিকানা।
কে এই নারী!
চন্দ্রাবতী নামেই অধিক পরিচিত। তার সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হয়েছে। সম্প্রতি ‘চন্দ্রাবতী কথা’ নামে একটি ছবি নির্মিত হয়েছে। ছবির পোস্টার দেখে মনে হবে, এই কাহিনী বুঝি আমাদের দেশের নয়। এভাবেই আমাদের গর্বের অসাধারণ উপাখ্যান হারিয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রাবতীর বাড়ি দেশের পূর্বাঞ্চলের হাওড়বেষ্টিত বৃহত্তর ময়মনসিংহে (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিমি পূর্ব-উত্তরে ফুলেশ^রী নদী পাড়ের পাতুয়ারি গ্রামে)। স্থানীয়দের কাছে চন্দ্রাবতীর গ্রাম নামেই পরিচিত। কেউ বলেন কাছারিপাড়া। কিশোরগঞ্জ থেকে আঁকাবাঁকা পাকা সড়ক ধরে যাওয়ার পথে একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে, নীলগঞ্জ। মনে হবে, এ বুঝি বরেণ্য সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকের ‘সুখী নীলগঞ্জ’! এটি অবশ্য একটি হাওড় এলাকা। বিস্তীর্ণ ভূমি। কোথাও নিচু। তবে জলাশয়ের চিহ্ন এখনও আছে। লোকজন জানালেন, বর্ষাকালে জলমগ্ন থাকে। এই পথে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে মধ্যযুগের স্থাপনা যা আজ মলিন-ছেড়াপাতার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
চন্দ্রাবতীর বাড়ি এই গ্রামে। ছিলেন শিবের সাধক। শিবের প্রতি অপার ভক্তি চন্দ্রাবতীকে এগিয়ে নেয় কাব্যের জগতে। এই কাব্য তাকে বুঝিয়ে দেয় নারীর ক্ষমতায়নে। সেই আলোর পথ ধরে এগিয়ে যায় চন্দ্রাবতী। তার নামে বাড়ির কাছে নির্মিত হয় দুটি শিবমন্দির। কালে কালে সেই বাড়ি ও শিবমন্দির ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। ১৯৮৭ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর এগুলো সংরক্ষণ করেছে। চন্দ্রাবতী মন্দির অষ্টভুজাকৃতির। উচ্চতা ৩২ ফুট। আটটি বাহুর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৮ ফুট করে। নিচতলায় একটি কক্ষ পোড়ামাটিতে অলংকৃত।
চন্দ্রাবতী কেন শিবের ভক্ত ছিলেন সে সম্পর্কে কাহিনী কিংবদন্তি হয়ে আছে। কিশোরী চন্দ্রাবতীর খেলার সাথী ছিল জয়নন্দ। ফুলেশ^রী নদীর এক তীরের গ্রাম পাতুয়ারি ছিল চন্দ্রাবতীদের বাড়ি। অপরতীর সুন্ধা গ্রামে ছিল অনাথ কিশোর জয়নন্দের বাস। পুষ্পবনে গিয়ে ওরা দুজনে শিবপূজার ফুল তুলে আনত। শিশুমনে খেলার ছলে দু’জন মালা বানিয়ে একে অপরের গলে পরিয়ে দেয়। ভাবাবেগে প্রণয়ের পিঁড়িতে বসে। কথা ছিল, দু’জনার এই প্রণয় পরিণয়ে রূপ নেবে। বিয়ের দিনক্ষণ লগ্নও ঠিক হয়। কিন্তু বিধিবাম! ত্রিভুজ প্রেমের ঘূর্ণিপাকে একে অপর থেকে ছিটকে পড়ে। বিচ্ছেদের এই ছন্দলয় চন্দ্রাবতীকে প্রভাবিত করে কাব্য সাহিত্যের পথে।
চন্দ্রাবতীর জন্ম ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। তাকে নিয়ে আছে অনেক মিথ। পঞ্চাশ বছরের জীবনে সাহিত্যের যে ধারা চন্দ্রাবতী সূচনা করেছেন তা কাব্যধারা ও পালাগানের সূত্রে গাঁথা। প্রতিটি ছত্রের পরে ‘গো’ শব্দটি এমন কাব্যিক করে এনেছেন যা মনের মাধুরীতেই আপনা আপনি আবেগ সৃষ্টি করে। যেমন ‘যবে এসেছিনু এই ভবে তব মন চাহে গো...।’ এমনই ছত্রে ছন্দের মাধুর্যে পিতা দ্বীজবংশী দাস ও মা সুলোচনা বংশী দাসের নির্দেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন চন্দ্রাবতী। সীতার দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণে বর্ণনা শুরু করেন, যেখানে তিনি রামের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার রচিত রামায়ণ পাঠ করে সেকালের প-িতরা বলেছিলেনÑ এ নারী অসাধারণ। লেখাতেই তিনি নারীকে কৃষিসভ্যতার কারিগর হিসেবে বর্ণনা করে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। নারী যে চলার পথের বিশাল শক্তি, নারীর ক্ষমতায়নে সমাজ ও সভ্যতা যে এগিয়ে যাবে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তার কাব্যসুধা সে যুগে নারীকে জাগিয়ে তোলে। রামায়ণে তার শক্তিধর লেখা এক পর্যায়ে হঠাৎ থেমে যায়। চন্দ্রাবতী রামায়ণ আর শেষ করতে পারেননি। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক হয়েই আছে। এরপরও চন্দ্রাবতীর রামায়ণ সে সময়ের মৈমনসিং (মধ্যযুগে এই বানান লেখা হতো) অঞ্চলে নারীর কণ্ঠস্বর হয়ে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চন্দ্রাবতীর রামায়ণের অংশ গীত হতে থাকে। চন্দ্রাবতীর সংস্কৃত কাব্য সাহিত্য সুর হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়। বলে দেয় চন্দ্রাবতীর সংস্কৃত জ্ঞানের পরিধি কতদূর বিস্তৃত। তিনি কাব্য ও পালাগানে বাংলা ও সংস্কৃত ব্যবহার করেছেন। যখানে এঁকেছেন বাংলার নৈসর্গিক দৃশ্য। একটি কাব্য কথার সূচনায় আছে ‘ধারাস্রোতে ফুলেশ^রী নদী বহিয়া যায়, বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়...’।
মৈমনসিং অঞ্চলের প্রখ্যাত উপাখ্যান মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা ছিলেন চন্দ্রাবতী। এর আগে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাবাকে নিয়ে মনসা দেবীর ভাসান রচনা করেন। পরে এই ভাসান বেহুলা উপাখ্যানের বড় অংশ হয়ে যায়। মলুয়া উপাখ্যানেও চন্দ্রাবতী নারীর জীবনধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
নিকটঅতীতেও চন্দ্রাবতীর গ্রামে যাওয়া ছিল দুর্গম-বন্ধুর। হাওড়বেষ্টিত এই অঞ্চলে যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। পরে এলাকা উন্নত হতে থাকে। নির্মিত হয় পাকা সড়ক। এখন সরাসরি কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে নেমে চন্দ্রাবতীর গ্রামে যেতে সব ধরনের যান্ত্রিক যানবাহন পাওয়া যায়। পাকা সড়ক ধরে চন্দ্রাবতীর গ্রামে গিয়ে কাব্য সাহিত্যের কীর্তিমান নারীর বাসভবন-মন্দির চোখে পড়ে। তবে এলাকার প্রবীণরা জানান, এই প্রাসাদোপম বাড়ি চন্দ্রাবতীর উত্তরসূরিদের তৈরি, কালের পরিক্রমায় চন্দ্রাবতীর পরিচিতি বহন করছে। বাড়ির কাছে হালে নির্মিত হয়েছে দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য কংক্রিটের ছাতা। বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় হালে হাওড়বিলাসী পর্যটক চন্দ্রাবতীর বাড়ি দেখে আসেন। স্থানীয়রা বললেন, আগে কেউ আসত না, এখন অনেকেই আসছেন।
চন্দ্রাবতীর বাড়ি আর শিব মন্দিরের ভগ্নদশা এখন। বছর কয়েক আগেও একজন পাহারাদার ছিলেন। এখন কেউ নেই। অবশ্য, সদর উপজেলা পরিষদ দেখভাল করে। চন্দ্রাবতীর নামে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় চোখে পড়ে। এলাকার আব্দুর রউফ জানান, চন্দ্রাবতী মঞ্চ তৈরি হয় ২০১১ সালের জুলাইয়ে। এখানে হালে নাটক মঞ্চস্থ হয়। তিনি বলেন, চন্দ্রাবতীকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। ময়মনসিংহ গীতিকার এক কবি নয়নচাঁদ চন্দ্রাবতীর চরিতকথা রচনা করেছেন। বগুড়া সরকারী আযীযুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ত্বাইফ আল মামুন বললেন- আমাদের সাহিত্যে চন্দ্রাবতীকে নিয়ে তেমন লেখা নেই। উচ্চতর শ্রেণীর পাঠে কিছু অধ্যায় আছে, যা যথেষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও কল্পবিজ্ঞানে তার ভাবনার যে বাস্তবায়ন তা বর্তমান প্রজন্মের জানা দরকার।