
কাওসার রহমান ॥ সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির সুখবর দিতে যাচ্ছে বন বিভাগ। সর্বশেষ ত্রিদেশীয় জরিপে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সংখ্যা এখন ১০৬ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪ তে। যদিও প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় এ সংখ্যা ১৩০ হতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। গত তিন বছরে খুব একটা বেশি না বাড়লেও আশার কথা হলো, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। ১০৬ কে ভিত্তি হিসাবে ধরলে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যার এই বৃদ্ধি একটি ইতিবাচক দিক। চোরা শিকারী প্রতিরোধসহ সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যতে বাঘের সংখ্যা যে আরও বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
জানা যায়, সুন্দরবনে তৃতীয় বাঘ শুমারির কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর। প্রথম দফায় সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘ মনিটরিং করা হয় ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জে মনিটরিং শুরু হয়। এই মনিটরিংয়ের কাজ শেষ হয় মে মাসে। একেকটি রেঞ্জে জরিপ কাজ সম্পন্ন করার পর অর্থাৎ ছবি তোলার পর ছবিসহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। আধুনিক ল্যাবে সফটওয়ারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এ্যানালাইসিস করা হয় মনিটরিংয়ের সময় তোলা ছবিগুলো। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এসব ছবি পর্যালোচনা করেন। যাতে শুধু বাঘের সংখ্যাই নয়, বাঘের বিচরণ ও ঘনত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনটি রেঞ্জের সার্ভে রিপোর্ট পর্যালোচনা শেষে গোটা সুন্দরবনে বাঘের মোট সংখ্যা চূড়ান্ত করা হয়। আসন্ন বাঘ দিবসকে সামনে রেখে এই সর্বশেষ বাঘ জরিপের ফল প্রকাশ করা হবে বলে জানা যায়।
বাঘ শুমারির বাঘ প্রকল্পের কাজ চলাকালেই বন বিভাগের কর্মকর্তারা বিভিন্ন তথ্য -উপাত্ত দেখে বুঝতে পারছিলেন শুমারিতে বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে খুব একটা না বাড়লেও শুমারি হতাশ করেনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। সর্বশেষ জরিপ থেকে এবার বাঘের সংখ্যা আটটি বেড়েছে। যা বন বিভাগকে আশাবাদী করেছে। ফলে বন বিভাগ বাঘ সংরক্ষণে মনিটরিং, টহল ব্যবস্থা জোরদার এবং বনরক্ষীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়। অবশ্য তথ্য-উপাত্ত যাচাইকালে প্রাথমিক হিসাবে বাঘের সংখ্যা ১৩০ দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। তবে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে প্রকৃতপক্ষে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪ ।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে প্রথম বেসরকারী উদ্যোগে বাঘ জরিপ করেন জার্মান প্রাণী গবেষক হেন রিডসে। তখন সুন্দরবনে ৩৫০ বাঘের খবর জানা যায়। ১৯৮২ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৫৩। ২০০৪ সালে পাওয়া যায় ৪৪০ বাঘ। কিন্তু দুই বছর আগে ২০১৬ সালে জানা যায় সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিমের ২৬ ভাগ এলাকায় বাঘ আছে ১০৬। সেবার কিছু ক্যামেরা ট্র্যাপিং ও পায়ের ছাপ দেখে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এবার শুধু ট্র্যাপিংনির্ভর জরিপ হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, পায়ের ছাপ থেকে ক্যামেরা ট্র্যাপিং বেশি নির্ভরশীল ও বিজ্ঞানসম্মত। ফলে তিন বছর আগে প্রাপ্ত ১০৬টি বাঘের চেয়ে এবারের জরিপে সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৬ সালে আমেরিকার দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি অর্থায়নে বাঘ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্যামেরার সাহায্যে এ গণনা করা হয়। ইউএসএআইডি এবং বাংলাদেশ সরকারের ১১৪ কোটি টাকায় পরিচালিত হচ্ছে বাঘ প্রকল্প। এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত। বাঘ মনিটরিং সার্ভে প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড টিম যৌথভাবে এ সার্ভে পরিচালনা করেছে। এর আওতায় দেশজুড়ে বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়াতেও বেশ কিছু কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এবার পায়ের ছাপ অর্থাৎ পাগমার্ক দেখে বাঘ গণনা করা হয়নি। বাঘের ছবি তুলে গণনা করা হয়েছে সংখ্যা। এ জন্য পূর্ব সুন্দরবন এলাকার প্রতি দুই কিলোমিটার পরপর বসানো হয় ক্যামেরা। এতে বেশ কিছু বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া যায়। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যৌথভাবে চালানো প্রথম এই জরিপে মিলেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের পাশাপাশি খাল সার্ভের মাধ্যমেও বাঘ মনিটরিং করা হয়। বাঘের সংখ্যা গণনার পাশাপাশি বাঘ যেসব প্রাণী খায় (হরিণ, শূকর প্রভৃতি) সেগুলোর অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করা হয়। বাঘ রক্ষায় কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশেই এই মনিটরিং বলে জানা গেছে।
বন বিভাগের তথ্য আনুযায়ী, গত ১৮ বছরে ৫০ বাঘ মারা গেছে। যার অর্ধেকের বেশি মেরেছে মানুষ। নতুন এলাকা ও খাবারের সন্ধানে বন থেকে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় স্থানীয়দের পিটুনিতেও মারা যায় বেঙ্গল টাইগার। তবে বাঘ হত্যায় বনদস্যুদের দায় শতভাগ। চোরাকারবারিদের চাহিদা অনুযায়ী বনের গভীরে বাঘ হত্যা করে তারা। অবশ্য দুই বছর ধরে বনদস্যুরা আত্মসমর্পণ করায় বাঘ হত্যা কিছুটা কমেছে।
আগে প্রতিবছর তিন থেকে সাতটি হত্যার ঘটনা ঘটত। কিন্তু জেলে, বাওয়ালিরা বলছে, বনে এখন ঘন ঘন গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও শাবকের দেখাও তারা পেয়েছ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বন বিভাগে টহল ‘স্মার্ট টিম’ বেশ তৎপর। নিয়ন্ত্রণের রয়েছে চোরা শিকারিদের চলাফেরা। ভারতের ডাকাতরা এখন আর বনে প্রবেশ করতে পারে না। আগের যে কোন সময়ের চেয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এখন নিরাপদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন বিভাগের কর্মীদের আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। কোন এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে জনবলের অভাবে ঘটনাস্থলে লোক পৌঁছাতে সময় লাগে। অথচ এই প্রাণীটি রক্ষায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। সুন্দরবনের মতো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের প্রধান প্রাণী রক্ষায় প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে নজরদারি করা উচিত।
বাঘের জিনোম আবিষ্কার ॥ পৃথিবীতে একমাত্র নোনা পানি খেয়ে বেঁচে আছে বেঙ্গল টাইগার। দুনিয়ার সব শ্বাসমূল বনের মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই রয়েছে বাঘ। শ্বাপদসংকুল এই ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারের বনে কিভাবে টিকে আছে বাঘ তা এখনও অজানা। বনের বাইরে মানুষের বাজারে বেঙ্গল টাইগারের দরটা বেশ চড়া। দেশের বাইরে পাচার হওয়া বাচ্চা ও চামড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হলে জিনোম সিকোয়েন্সের নমুনা প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
অথচ ভারত ও নেপাল বাঘের জীবনচিত্র আবিষ্কারে সফল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যেহেতু ঢাকা চিড়িয়াখানা ও কক্সবাজার ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে সুন্দবনের তিনটি বাঘ আছে। তাই জিনোম আবিষ্কারে খুব একটা কষ্ট হবে না। দ্রুত জীবন রহস্য উদঘাটন না করতে পারলে বাঘের ভৌগোলিক মালিকানাও হারাতে পারে বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, বিশ্বের ১৩টি দেশের বনাঞ্চলে সাইবেরিয়ান, সুমাত্রা, ইন্দো, চায়নায় বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিললেও, হারিয়ে গেছে পেসপিয়ান, বার্লিনী ও জাভান টাইগার। আবাসস্থল ধ্বংস, অবৈধ শিকার, বনভূমি উজাড় ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে বাঘের সংখ্যা। এ বাস্তবতায় ২০১০ সালে রাশিয়ায় প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ঘোষণা আসে ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালনের। একই সঙ্গে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করা হয়।