ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

আগুনে পোড়া স্বজন ॥ বিষাদের পঙ্ক্তিমালা

যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি...

প্রকাশিত: ১১:০২, ৩১ মার্চ ২০১৯

যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি...

মোরসালিন মিজান ॥ দুটি উচ্ছল তরুণী। উভয়ই কবিতা, শুধু কবিতা নিয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দকে বড় ভালবেসে আবৃত্তি করে তারা। এই সেদিনও শিল্পকলা একাডেমিতে কবিতা পড়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাড়ি ফিরছিল, প্রতিদিনই ফেরে, এদিন পথ আগলে দাঁড়াল আগুন। চকবাজারের সর্বনাশা আগুন ছোঁ মেরে নিয়ে গেল তাদের। বাড়ি ফিরতে দিল না। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মুখে হাসি। সেই হাসি আজ বাবা মায়ের চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের সদস্যরা যেমন অশ্রুসজল, তেমনি শোক করছে আবৃত্তি অঙ্গন। বাচিক শিল্পীদের সবাই নিহতদের চিনতেন জানতেন- এমন নয়। এরপরও বিষাদে ডুবে আছেন। কবি মহাদেব সাহার ভাষায় বললে, ‘বিষাদ ছুঁয়েছে আজ মন ভাল নেই।’ দোলা ও বৃষ্টির কথা ভেবে মন খারাপ সহশিল্পীদের। আর তাই বেদনামাখা কবিতা আলাদা করে খুঁজে নিয়ে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসেছিলেন তারা। সেখান থেকে আবৃত্তি করেন। কথা ও কবিতায় স্মরণ করা হয় দোলা ও বৃষ্টিকে। একই আয়োজন থেকে সদ্য প্রয়াত নিখিল সেনের অবদানের কথা তুলে ধরা হয়। প্রবীণ বাচিক শিল্পীর মৃত্যুটি, হ্যাঁ, স্বাভাবিক নিয়মে। বাকি দুটিকে সচেতন মানুষ মাত্রই বলছেন, খুন। হত্যা। তাই ঘুরে ফিরে আসছিল দুই তরুণীর মৃত্যু প্রসঙ্গ। প্রতিকার চাইলেন বাচিক শিল্পীরা। এভাবে যতটা কষ্ট, ততটাই ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটানো হয় অনুষ্ঠান থেকে। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন সংগঠনের সভাপতি আসাদুজ্জামান নূর, সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ। ইস্তেকবাল হোসেনের সভাপতিত্বে সূচনা বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহ্কাম উল্লাহ। প্রার্থনা সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এ সময় বহ্নিশিখার শিল্পীরা গাইছিলেন: তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে; /তব পুণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে...। রজনীকান্ত সেন বিকেল বেলার করুণ সুর হয়ে বাজছিল যখন, খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পীরা তখন প্রয়াতদের প্রতিকৃতির সামনে গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে দিচ্ছিলেন। এর পর দাঁড়িয়ে এক মিনিটের নীরবতা পালন করেন সবাই। অনুষ্ঠানে প্রথম আবৃত্তি করেন মুনিরা ইউসুফ মেমী। কবিগুরু থেকে তিনি উচ্চারণ করেন- ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,/সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,/মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে...। কবিতার মতো কথায়ও আবেগ জড়িয়ে ছিল। আলোচনা পর্বের মূর্খ বক্তা আসাদুজ্জামান নূর বলেন, দুটি চঞ্চল প্রাণ আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে আগুনে পুড়ে মৃত্যু। চকবাজারের ভবনগুলোতে বিস্ফোরক সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের বিবেক, মানবিকতা কাজ করে না। শুধু লোভ কাজ করে। দেশ উন্নত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মানবিকতা, অনুভূতি, সংবেদনশীলতা কোথায় হারাচ্ছে? সংসদ সদস্য ও সাবেক এই মন্ত্রী অসহায়ের মতো বলেন, সমাজটা কোনদিকে যাচ্ছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ পর্যায়ে কামব্যাক করার চেষ্টা করে তিনি বলেন, এখানে অনেকের ভেজা চোখ দেখছি। কিন্তু শুধুই কি কান্না করব আমরা? আমরা প্রতিবাদ করব না? কেন মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে? আজ আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হবে। একটা মানবিক সমাজ গড়ে তোলার প্রয়োজনে শক্ত সবাইকে শক্ত অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। বৃষ্টি ও দোলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে তাদের নামে তরুণ আবৃত্তি শিল্পীদের জন্য পদক প্রবর্তনের ঘোষণা দেন খ্যাতিমান অভিনয় এবং আবৃত্তি শিল্পী। অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, চৈত্রের বাতাস উদাস করা হয়। আজ উদাস করা এবং শোকের। একজন মানুষ একেবারেই প্রকৃতির নিয়মে বার্ধক্যে এসে চলে গেলেন। এই চলে যাওয়াটা মানতে আমরা শিখেছি। কিন্তু বাকি দুজন আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেল। এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, শহীদ মিনার শোক ভুলে সত্য প্রকাশ করতে শেখায়। সত্য প্রকাশ করে বলছি, বৃষ্টি এবং দোলার মৃত্যু কোন দুর্ঘটনা নয়। একের পর এক মানবিক বিপর্যয়কে আমরা দুর্ঘটনা বলে পার পেতে পারি না। এর বিপরীতে কবিতার ভাষায় গর্জে ওঠার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, আমরা যদি আবৃত্তির মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমকে ধারণ করতে পারি তবেই প্রয়াত শিল্পীদের আত্মা শান্তি পাবে। এর আগে সূচনা বক্তব্যে প্রেক্ষাপট টেনে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ বলেন, আজ আবৃত্তিশিল্পীদের জন্য যারপরনাই বিষণ্ণ একটি দিন। জীবনের সবচেয়ে সত্য হচ্ছে জন্ম এবং মৃত্যু। এর পরও আমাদের প্রিয়জনেরা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায়, বিশেষ করে অপমৃত্যুর শিকার হয়, আমরা ব্যথিত হই। কাঁদি। তিনি বলেন, নিখিল সেনের মতো মানুষেরা ছিলেন বলেই সারাদেশে আবৃত্তির মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। আর এমন একটি মঞ্চ থেকে ফেরার পথেই কিনা আগুনে পুড়ে মারা যায় বৃষ্টি এবং দোলা। পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তারা দুর্ঘটনার শিকার হন বলে জানান তিনি। বলেন, অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের বোনদের সন্ধান মেলেনি। আমাদের আশা ছিল, বেঁচে আছে। কিন্তু শেষতক অকাল মৃত্যুর খবরটি সত্য হয়। আমরা সেই কয়লা হয়ে যাওয়া বোনদের স্মরণ করার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। তিনি জানান, একই সময়ে সারাদেশের ২৫ স্থানে বৃষ্টি এবং দোলা স্মরণে কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে। তবে বৃষ্টি ও দোলার পরিবারের কেউ তেমন কথা বলতে পারলেন না। কেঁদে গেলেন শুধু। এতদিন ধরে কাঁদছেন তারা। কান্না তবু শেষ হয় না। এমনই বেদনার এই চলে যাওয়া। দোলার বাবা দলিলুর রহমান যখন মাইকের সামনে দাঁড়ান সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন কিছু শোনার জন্য। শোনাতে পারলেন না তিনি। অঝোরধারায় কাঁদলেন। বললেন, কিছু বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই। মাঝে মাঝে আমি জসীমউদ্দীনের কবিতা থেকে আবৃত্তি করি- যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি...। আবৃত্তি শিল্পীর বাবার কণ্ঠে এমন কবিতা নতুন করে চোখের জলে ভাসায় সবাইকে। বৃষ্টির বোন সাবেরা সুলতানা ইভা মাইকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েক সেকেন্ড। বলতে পারছিলেন না কিছু। অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, আপনাদের অনেক ভালবাসা ছিল বৃষ্টির প্রতি। দোলার প্রতি। দোয়া করবেন যেন দুই বোন অনেক ভাল থাকে। আর কিছু বলার নেই। বাকি কথা ভেসে যায় চোখের জলে। ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনুষ্ঠানের সুন্দরতম দিক ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দলের অংশগ্রহণ ও আবৃত্তি পরিবেশনা। দলীয় পরিবেশনার পাশাপাশি ছিল একক আবৃত্তি। সবাই মায়া ভরা কণ্ঠে হারানো স্বজনদের স্মরণ করেন। দুর্ঘটনার নামে যে মৃত্যু, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এমন আবেগী পরিবেশনা, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ অনেকদিন পর দেখা যায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল।
×