ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

৪৫ বছর পূর্তি

লাল-সবুজের পতাকা, গালে আল্পনা আঁকা তরুণ প্রজন্মের বিজয়োৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬

 লাল-সবুজের পতাকা, গালে আল্পনা আঁকা তরুণ প্রজন্মের বিজয়োৎসব

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বিজয়ের ৪৫ বছর উদযাপনে ব্যস্ত বাংলাদেশ। বিজয় দিবস ঘিরে কুচকাওয়াজ, শোভাযাত্রা, প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ দিনটিকে উদযাপন করেছে নিজস্ব ঢঙে। রাজধানীর তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিজয় উৎসবের প্রভাব আরও বেশি লক্ষ্য করা গেছে। বেশিরভাগ তরুণদের মধ্যেই লাল-সবুজ ছেয়ে গেছে। গালে পতাকা আঁকিয়ে, কপালে পতাকা বেঁধে ও লাল-সবুজ পোশাক পরে তাদের বিজয় উদযাপনে মেতে উঠতে দেখা গেছে। রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে যেতেই চোখে পড়ল ছোট বড় অনেকের গালেই লাল-সবুজে আঁকা আল্পনা। আল্পনাগুলোর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেÑ মহান বিজয় দিবস, ১৬ ডিসেম্বর, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলাদেশ লেখাগুলো। এছাড়া মানচিত্র আঁকা জাতীয় পতাকাসহ লাল-সবুজের চারকোণা পতাকা তো আছেই। যিনি আল্পনা আঁকাচ্ছেন তার সামনে তখনও ভিড়। এবার ছয়-সাত বছরের একটি মেয়ের পালা। তার গালে আঁকানো হচ্ছে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা। গালে কেন পতাকা আঁকাচ্ছ? উত্তরে তারিন নামে মেয়েটি বলল, ‘আজকে বিজয় দিবস। এই দিনে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাই পতাকার আল্পনা গালে আঁকিয়ে নিচ্ছি। খুব ভাল লাগছে এতো মানুষ দেখে। সবাইকে লাল-সবুজ লাগছে।’ তুষার নামে ওই আল্পনা আঁকিয়ে বললেন, ‘আজ সকাল থেকেই ছোট বড় অনেকেরই গালে-হাতে আল্পনা এঁকে দিয়েছি। অনেকেই আল্পনা আঁকাতে পছন্দ করেন। খুবই ভাল লাগে যখন কেউ আগ্রহ দেখিয়ে নিজ গালে কিংবা হাতে আল্পনা আঁকতে চাই। অনেকেই খুশি হয়ে টাকা দেয় আবার অনেকেই দেন না। সবাইকে আল্পনা আঁকিয়ে দিয়েই আমি খুশি। জাতীয় পতাকা যতবারই আঁকায় ততবারই দেশের প্রতি ভালবাসা অনুভব করি। এই দেশের নাগরিক হয়ে সত্যিই আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও দেখা মিলল শত শত তরুণ-তরুণীর। যাদের সবার মাঝেই রয়েছে লাল-সবুজের ছোঁয়া, মুখে বিজয়ের হাসি। বিজয়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়েই দেশবাসী বিজয়োৎসব উদযাপন করেছে। কপালে মানচিত্র সংযুক্ত জাতীয় পতাকা বেঁধে উদ্যানে ঘুরতে দেখা গেল কলেজ শিক্ষার্থী রাকিবকে। বললেন, ‘বিজয়ের মাস মানেই লাল সবুজে নিজেকে জড়িয়ে রাখা। তবে লাল-সবুজের পতাকা সবকিছুর উর্ধে। এই পতাকায় আমাদের শক্তি। কপালে যখন পতাকাটি বেঁধেছি তখন থেকেই নিজেকে যোদ্ধা বলে মনে হয়েছে। তবে জাতীয় পতাকার চেয়ে পুরনো মানচিত্র আঁকা পতাকাটির মাঝে পুরো দেশকে দেখতে পাই।’ বাঙালী জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের দিনটি। এই দিনটি উদযাপনে আনন্দের পাশাপাশি আছে বেদনাও। দেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব বীর সন্তান তাদের মূল্যবান জীবন দেশের মাটির জন্য উৎসর্গ করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যেমন দেশ তেমনি দেশের বর্তমান প্রজন্মও। লাল-সবুজে নিজেদের সাজিয়ে গভীর বেদনা ও পরম শ্রদ্ধায় মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সন্তানদের স্মরণ করছে তরুণরা। তাদের মধ্যেও দেখা গেছে শহীদদের প্রতি সেই মমত্ববোধ। গালে পতাকা আঁকিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারিয়া। শহীদদের স্মরণ করে তিনি বললেন, ‘দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রামের পর আমাদের দেশের অকুতোভয় তরুণেরা এই দেশকে স্বাধীন করেছে। আজকের দিনটি আমাদের প্রজন্মের কাজে যেমন প্রাপ্তির তেমন দুঃখেরও বটে। শহীদরা তাদের রক্ত দিয়ে যেভাবে দেশকে স্বাধীন করেছেন আমাদেরও উচিত রক্ত দিয়ে হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করা।’ আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিল হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। লাল-সবুজ পতাকা তুলে ধরে বিজয়ী বাঙালীরা। সেই পতাকা আজও উড়ছে প্রগতির পথে। লাল-সবুজের বিজয় নিশান উড়বেই... টুঙ্গিপাড়ায় নূরু মিয়া এবারও রিক্সা চালিয়ে ঢাকা এসেছেন ॥ এমদাদুল হক তুহিন, ‘রক্তমাখা সাজানো অস্ত্র। বাঁশের তৈরি রাইফেল। সাজানো কামান। নৌকায় বসে হুক্কা টানছেন কৃষক। নিথর দেহের সবুজ গেঞ্জি পরা মানুষটির গলায় ঝুলছে ফুল। যেন যুদ্ধে শহীদ! হাত উঁচিয়ে তারই সহযোদ্ধা ফিরছেন বিজয়ের বেশে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সবাই মেতে উঠছেন বিজয় উল্লাসে’- দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ। বিজয় দিবসকে আরও রঙিন করে তুলতে, আরও আনন্দের করে তুলতে সেসব বীর সেনানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজধানীর রাস্তায় আবারও দেখা মেলে সেই প্রতীকী ’৭১। তুলে ধরা হয়- দেশের স্বাধীনতা অর্জন শেষে, রণাঙ্গন জয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে আসার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এ আমার গৌরব, এ আমাদের ঐতিহ্য; এ আমার রক্তে পাওয়া বাংলাদেশ। পুরো দিন বাংলাদেশ সেজেছিল লাল-সবুজে। চায়ের স্টল, যানবাহন; সর্বত্র ছুঁয়েছে লাল-সবুজ। অলি-গলিতে কাগজের পতাকা। বাসা-বাড়ির ছাদে। ভোরে কোন কোন বাসার ছাদে, কার্নিশে দাঁড়িয়েও তোপধ্বনি শুনতে দেখা গেছে নগরবাসীকে। আর দূর থেকে মাইকে ভেসে আসা বিজয়ের গান, বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠ মানুষের রক্ত কণিকাতেও শিহরণ জাগিয়েছে বিজয়ের দিনে। বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠতে এবারও রিক্সা চালিয়ে ঢাকায় এসেছেন গোপালগঞ্জের মুজিব পাগল নূরু মিয়া। রাজধানীর ছবির হাটের সামনের রাস্তায় তার সঙ্গে কথা হলো। তাকে কাছে পেয়ে তার সঙ্গে ছবি ও সেলফি তোলার ভিড় জমে টুঙ্গিপাড়ার নূরু মিয়া বলেন, ‘স্বাধীনতা আমার গর্ব। তাই বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠতে এবারও রিক্সা চালিয়ে ঢাকায় এসেছি। টুঙ্গিপাড়া থেকে আসতে তিন দিন লেগেছে। টেকেরহাট ও ভাঙ্গায় বিরতি নিয়েছি।’ তিনি জানালেন, বিজয় র‌্যালিতে অংশ নিয়ে দুপুরের খাবার সেরেছেন রাস্তাতেই। যুদ্ধের সময় পাক হায়েনাদের গ্রেনেডের আঘাতের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। তবে এ ক্ষতচিহ্ন গর্বের প্রতীক। তিনি জানান, যুদ্ধে অংশ নিলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা কার্ড নেননি। নৌকা পাগল নূরু মিয়া পুরোদেশেই পরিচিত। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমার রিক্সাতে একবার উঠেছেন, শেখ হাসিনা উঠেছেন দুইবার।’ বঙ্গবন্ধু ঠিক কবে উঠেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে। আইয়ুব তখন ক্ষমতায়। দেশে তখন বন্যা। সে সময় রিক্সায় করে বঙ্গবন্ধুকে ফুলছড়ি রেলস্টেশনে নামিয়ে দিই। তখন আমি স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম।’ শেখ হাসিনা আপনাকে ঠিক কী দিয়েছেন- এমন প্রশ্নে নূরু মিয়া বলেন, ‘অনেক কিছুই দিয়েছেন। খালেদার আমলে আমার দুইবার জেল হয়। হাইকোর্টে রিট করে তিনি আমাকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। তিনি আমাকে খুব মায়া করেন। শেখ পরিবারের সবাই আমাকে মায়া করেন, ভালবাসেন।’ বিজয়ের এই আনন্দে আপনার প্রত্যাশা কী- এমন প্রশ্নে নূরু মিয়া বলেন, ‘মুজিব আমার চেতনা, মুজিব আমার আদর্শ। আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করবে- এটাই আমার প্রত্যাশা।’
×