
ছবি: জনকণ্ঠ
রাজধানী ঢাকার বইমার্কেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অন্যতম নীলক্ষেত। দেশি-বিদেশি, ইংরেজি-বাংলা থেকে শুরু করে নতুন-পুরাতন সকল ধরণের বইয়ের দেখা মিলবে এখানে। বই ছাড়াও ফটোকপি, কম্পোজ, বাঁধাইসহ শিক্ষা উপকরণের বহু দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে এই মার্কেটে।
আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, ভিকারুননিসা, সিটি কলেজ, গভ. ল্যাবরেটরি, সাত কলেজসহ ঢাকার সবার বই কেনার জন্য চিরচেনা জায়গা হচ্ছে নীলক্ষেতের এ বইয়ের মার্কেট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই মার্কেটগুলো। ৯টি আলাদা আলাদা মার্কেট নিয়ে তৈরি হয়েছে নীলক্ষেতের বইমার্কেটগুলো। তবে, দীর্ঘদিন ধরেই এই মার্কেটগুলো রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে,নেই কোনো অবননচনচগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। হঠাৎ যদি কখনও আগুন লাগে তাহলে ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, সিটি কর্পারেশন চাইলে এসব মার্কেটগুলোকে নিয়ে একটি সুন্দর রূপরেখা তৈরি করতে পারে নাহলে ভবিষ্যতে ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। বর্তমানে যে দাবদাহ চলছে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে সকলকে, জনসচেতনতাও বৃদ্ধি জরুরী।
রবিবার (১১ মে) নীলক্ষেত হকার্স মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, হযরত বাকুশাহ, সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, ইসলামিয়াসহ ৮ থেকে ৯টি মার্কেট মিলে গঠিত এই মার্কেটে প্রতিটি দোকান একটি আরেকটির সাথে লেগে আছে। গলিগুলো বেশিরভাগই চিপা, একজনের বেশি পাশাপাশি হাঁটার জায়গা নেই। এমনকি খালি চোখে বোঝারও উপায় নেই এখানে একাধিক মার্কেট রয়েছে। আবার একটির উপরে আরেকটি দোকান স্থাপন করা হয়েছে। পুরো মার্কেট ঘুরে মোট ১৬ টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের দেখা মিললেও কোনোটিরই ছিল না মেয়াদ। এছাড়াও, মূল ফটকে সহ মার্কেটের ভেতরে রয়েছে একাধিক খাবার হোটেলও। রান্নাও করা হয় মার্কেটের ভেতরেই।
দোকানিরা বলছেন, প্রায় প্রায়ই ছোট ছোট আগুনের ঘটনা ঘটে। তবে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিভিয়ে ফেলা যায়। তবে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা মার্কেটে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। এলোমেলোভাবে সব জায়গায় বৈদ্যুতিক তার, দোকানগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত ফাঁকা না থাকায় মুহূর্তেই সব জায়গায় আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এর আগেও খাবারের হোটেল থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল তখন ব্যবসায়ীরা ভাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মার্কেটটিতে নেই কোনো ফায়ার এক্সিট। আগুন লাগলে ছোট ছোট এই চিপা গলি দিয়েই সবাইকে মালামাল নিয়ে বের হতে হয়,সেক্ষেত্রে নিতে হয় জীবনের বাজি। তাৎক্ষণিকভাবে খাওয়ার পানির লাইন থেকেই পানি সংগ্রহ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকে না।
এই মার্কেটে উত্তরা থেকে বই কিনতে এসেছেন তামান্না জেরিন। জানতে চাইলে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার বড় বইমার্কেট বলতে আমরা নীলক্ষেতকে চিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসেন বই কিনতে। এসব দোকানগুলো খুবই ঘন,নেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা যা খুবই দুঃখজনক। আমার মনে হয় সরকারকে এটা নিয়ে ভাবা উচিত।
পাশেই দাঁড়িয়ে কম্পিউটারের দোকানে সিভি তৈরি করছিলেন মোরসালিন ময়েন। আক্ষেপের সুরে বলেন, ২০২২ সালে যখন আগুন লাগে ঠিক তার ১ ঘন্টা আগে আমি মার্কেট থেকে ঘুরে যায়। পরে খবরে জানতে পারি আগুন লেগেছে বইমার্কেটে। সেদিন আমার বড় কোনো ক্ষতিও হতে পারত। যেহেতু, নীলক্ষেত এই মার্কেটে সকল ধরণের মানুষ প্রতিনিয়ত আসে হঠাৎ বড় দুর্ঘটনা হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি ঘটবে। সরকারের এটা নিয়ে ভাবা উচিত। এটিকে জাতীয়ভাবে অনুমোদন দিয়ে পরিচালনা করা উচিত নতুন ভবন করে।
বাকুশাহ মার্কেটে ফটোকপি ও প্রিন্টের দোকান আছে কে.এম. রাসেলের। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মার্কেটগুলো অগ্নিঝুঁকিতে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আল্লাহ না করুক যদি বড় কোনো দুর্ঘটনা হয় তাহলে আমাদের সকলের অর্থনৈতিকভাবে ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। কেননা দোকানগুলো একটির সাথে আরেকটি এমনভাবে ঘেঁষে আছে মালামাল নিয়ে বের হওয়া তো দূরের কথা জীবন নিয়ে বের হওয়ায় কষ্টকর হয়ে যাবে। সরকারের উচিত এ মার্কেটগুলোর দিকে নজর দেওয়া কেননা প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণা থাকে এই মার্কেটে।
একথা শুধু রাসেলেরই নয় বেশিরভাগ দোকানিরা বলছেন সবসময় তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন। যদি কখনও বড় দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে কোটি কোটি টাকা লোকসান হবে তাদের। তবে, দোকানগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা নিয়ে নিজেদের দায়স্বীকার করেন অনেকেই। তারা বলছেন, এটা রাখি তবে মেয়াদউত্তীর্ণ হয়ে গেলে আর ঠিক করা হয়ে ওঠে না। এছাড়া, আমরা কয়েকটি দোকান ঠিকভাবে রাখলেও বেশিরভাগ দোকানদাররা রাখেন না।
হযরত বাকুশা হকার্স মার্কেট সমবায় সমিতির সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন মোহন বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাটা দুঃখজনক। আমরা জানি আগুন নেভানোর জন্য এখানে পর্যাপ্ত কোনও ব্যবস্থাই নেই। যেহেতু হকার্স মার্কেট তাই দোকানগুলোও একটা আরেকটার সাথে লাগানো এবং সব জায়গায় এলোমেলো বিদ্যুতের তার ঝুঁলছে। এখানে আগুন লাগলে সেটি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। তবে আমরা সর্বোচ্চ সচেতন থাকার চেষ্টা করি যাতে আগুন না লাগে। ছোট ছোট আগুনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। সেটা আমরা প্রাথমিকভাবেই নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলি। বড় কোনও ঘটনা ঘটছে না।
তিনি আরও বলেন, দেশে যখন বড় বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে আমরা তৎক্ষণাৎ ৩০টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এনে মার্কেটের বিভিন্ন খুঁটিতে লাগিয়ে দিয়েছি এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছি যে কীভাবে সেটি ব্যবহার করতে হয়। আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি আমাদের দিক থেকে। এছাড়া আমরা রাতেও সিকিউরিটি গার্ডসহ কয়েকজন দোকানিকে দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেই যাতে তারা রাতে কোথাও আগুনের ঘটনা ঘটলে দ্রুত নিভিয়ে ফেলতে পারে। এসব প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই মার্কেট চলছে। আশা করছি সামনে ভাল কিছু করতে পারবো আমরা।
প্রসঙ্গত, এক যুগ আগে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে পুলিশের সহযোগিতায় দোকান ভাঙার কাজ শুরু করে হকার্স মার্কেট সমবায় সমিতি। ভাঙা শুরু করলেও অনেক ব্যবসায়ী বিরোধীতা শুরু করলে মাঝে স্থগিত রেখে আবারও ভাঙা শুরু করে। তখন এ জি গ্রিন প্রপার্টি লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির চুক্তি হয়। ওই ডেভেলপার কোম্পানি দোকান মালিকদের সাইনিং মানি দিয়েছে এবং সমিতির সব সদস্য সে টাকা পেয়েছেন বলেও জানা যায়।
এছাড়াও, ২০২২ সালের মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মিনিটে এই মার্কেটের এক হোটেল থেকে আগুন লাগে নীলক্ষেত বইমার্কেটে।
সেসময় ফায়ার সার্ভিস সূত্রমতে, দোকানগুলো ঘিঞ্জি। এই মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র অপ্রতুল। এ কারণে আগুন দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তখন এ ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় নীলক্ষেতে ইসলামিয়া মার্কেটের ২৮ টা দোকান ও শাহজালাল মার্কেটের ৪১ টি দোকান মোট ৬৯ টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।