ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো, অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

আইয়ুব আল আমিন

(পূর্ব প্রকাশের পর)
বাগান থেকে রুমে যেতে আমরা আবার উপরে যাওয়ার জন্য লিফটে চড়লাম। তিনি তার কাঁধ কুঁজো করে দাঁড়িয়ে আছেন। লিফটের আয়নায় আমি আমাদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। যতকিছুই হোক না কেন, এটাই আসল যে- তিনি এখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, জীবিত। 
বৃহস্পতিবার ২৬, বুইসগিব্যু ( আচরণ, শৃঙ্খলা, আন্তরিকতা, বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতা)
এটা কেন যেন আমার মনে হলো- তিনি কখনোই তার শরীরটাকে সেভাবে ভালবেসে যতœ নেননি। তিনি কখনোই তার মুখ, চুল অথবা বাহুগুলোকে আদর দিয়ে স্পর্শ করেননি।  এখনকার এইসব দিনে যেভাবে যত্ন করে আমি করছি। তিনি আলতোভাবে ব্লাউজের ভেতরে তার হাত গলিয়ে দেননি- পোশাক পরতে সবসময়ই কেমন একটা অবহেলা আর অস্থিরতা ছিল তার, কিন্তু এখন তার ওই শরীরটির বেহাল অবস্থা, জরাজীর্ণ। অনাদরে নষ্ট হয়ে গেছে, যেন দিনটি ফুরিয়ে গেলেই তিনি তার চেয়ারের উপরে ধুপ করে ভেঙ্গে পড়বেন। 
খুব জেদি একজন মহিলা। একপ্রকারের মূল্যবোধের ভেতর বেঁচে থেকেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন। যেন এটাই তার ধর্ম ছিল। আমি নিশ্চিত নই- আমি তাকে নিয়ে যে বইটি লিখতে চাইছি- ঠিক ‘আ মেনস পেস’ বইটির (আমার বাবাকে নিয়ে লেখা বই) মতো করে আমি সেই বইটিও (আ ওমেনস স্টোরি) লিখতে পারবো কিনা? অতটা স্নায়ুর জোর আমার ভেতরে আছে কিনা? সেভাবে আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো দূরত্ব ছিল না। যতটুকুই দ্বন্দ্ব ছিল- তা ছিল শুধুমাত্র একজন আরেকজনের অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার একটি অমীমাংসিত বোঝাপড়া। 

আগস্ট শনিবার ১১
আজ তাকে দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং এই ব্যাপারটি কেন যেন তীব্র তৃপ্তির অনুভূতি দিচ্ছে, তার সঙ্গে দেখা করার সম্ভাবনায় প্রচ- আনন্দ অনুভব করছি, যেন আমি নিজের সম্পর্কে খুব মৌলিক কিছু সত্য জানতে সুযোগ পাচ্ছি। এটা তো স্ফটিকের মতন স্বচ্ছ যে- আমার মা/ সে তো আসলে আমিই। কিন্তু এখন তিনি বৃদ্ধা আর আমি দেখতে পাচ্ছি- কিভাবে তার শরীরটা দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মনে হচ্ছে যেন আমার শরীরটাই দিনদিন এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে- তার পায়ের বলিরেখাগুলো, তার ঘাড়ের উপরের ভাঁজগুলো, তার সাম্প্রতিক চুল কাটা। তিনি এখনো কেন যেন ভয় পান। তার এই ভয় পাওয়া ব্যাপারটা কখনোই তাকে ছেড়ে যায়নি। তিনি বলেন- ‘বসের মন বুঝে চলা খুবই কঠিন। আমরা যতই ভালো কাজ করি না কেন, তিনি যেন একদমই খুশি হন না আর আমাদের প্রাপ্য মজুরিটুকুও দিচ্ছেন না’।

এভাবে আরো কত কত গল্প বলতে বলতে একসময় তিনি থেমে গেলেন। আমি যে খাবারটা এনেছিলাম- সেটা খেতে শুরু করলেন। খাদ্য, প্রস্রাব, বিষ্ঠা- এই তিনটির মিশ্রিত ঝাঝালো গন্ধের প্রচ- একটি আঘাত- নাকে এসে পৌঁছুবেই, যখন কেউ লিফট ছেড়ে এই করিডোরে এসে দাঁড়াবে। প্রায়শই এখানে দেখা যায়, জোড়ায় জোড়ায় মহিলারা হাঁটছে। তাদের দুজনের দলগুলোর ভেতরে অপেক্ষাকৃত সবল যিনি তিনি প্রভাব-বিস্তারি ভূমিকা পালন করেন।

এই মুহূর্তে দেখছি- একজন লম্বা মহিলা যিনি তার চেয়ে খাটো একজনকে তার সঙ্গী করেছেন এবং তার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছেন। পুরো করিডোরটিতে জুতোগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটকে পড়ে আছে। এরা দুজন যার যার পায়ে চপ্পল গলিয়ে দিয়েই এমাথা ওমাথা হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এই পুরো জায়গাটি যেন একটি খাঁচা। আমার মা যেন একজন সন্ন্যাসিনী।
যখন আমি নিচতলায় যেতে এলিভেটরে চড়লাম, আয়নায় নিজের দিকে একবার তাকালাম, শুধু নিশ্চিত হতে যে ‘এটা আমিই, ফিরে যাচ্ছি’। 

সোমবার ২০
এখন যখনই তাকে দেখতে আসি, অনুভব করি আমি এখনো তরুণী, আমার ভালোবাসার জীবন আছে, সেই জীবনে একজন চমৎকার প্রেমিক আছে আর এভাবে আরো দশ পনেরোটি বছর তো চলেই যাবে। কিন্তু এক সময় আমি বৃদ্ধা হবো। তখনো আমি তাকে দেখতে আসবো। কিন্তু তাকে এভাবে দেখতে এলেও ধীরে ধীরে আমিও তো বুড়িয়ে যাবো।

তিনি আজ ভাবছিলেন- তিনি কি কি কেনাকাটা করবেন! জামা-কাপড়, ট্রাংক- এই রকম আরো কিছু কিছু জিনিসগুলো। কিন্তু তার নিজের তো কিছুই থাকবে না। তিনি যে পোশাকটি পরে আছেন, এটা হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়েছে; এটি নোংরা হয়ে গেলে পরিষ্কার করা অত্যন্ত সহজ। তিনি তার আগের জামাকাপড়- যেগুলো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন- তার সবগুলোই হারিয়ে ফেলেছেন, এমন কি তার সেই প্রিয় চশমাটিও, ছয়মাস আগেও যেটির খুব ভালো যত্ন নিতেন তিনি, আমার বাড়িতে যখন থাকতেন।

এখানে, এই হাসপাতালে কিছু হারিয়ে গেলে ওগুলো আর ফেরত পাওয়া যায় না। কেউ এসব পাত্তা দেয় না- কারণ, এরা তো সবাই মরেই যাচ্ছে। এখানকার প্রধান নার্স মহিলাটা- লম্বা,উদ্ধত মুখভঙ্গির, খাটো করে ছাঁটা চুলে এক ধরনের রোবটিক চেহারা। 
আরেকজন- সময় দেখে যে নার্স, তিনি একজন বয়স্ক লোকের কাছে গিয়ে তাকে তুলে ধরে ধীরে ধীরে সামনের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন। দুজন বৃদ্ধমহিলা হাত ধরাধরি করে করিডোরে হাঁটছিলেন, তারা আমার কাছাকাছি এসে দু’বার থামলেন। বললেন- শুভদিন ম্যাডাম। তাদের দেখে মনে হলো- তারা ভুলেই গেছেন যে, তারা এর মধ্যে আমাকে বেশ কয়েকবার একথাটি বলেছেন।

শুক্রবার ২৪
আমার মা আমার বাড়িতে যে জামাকাপড়গুলো রেখে গেছেন, সেগুলো আমি ল্যা সেকিউর ক্যাথলিককে দিয়ে দিতে চাই- এটি একটি দাতব্য সংস্থা। অথবা আমি পন্তোয়্যাজের ফ্লি মার্কেটেও বিক্রি করে দিতে পারি বলে ভাবলাম। অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করছে। তার সেলাই সরঞ্জামের ঝুড়ি- সেখানে বিবিধ সুচ আর অনেক রকমের বোতাম রাখা ছিল। এইসব কিছুতে তার ঠোঁটের স্পর্শ লেগে আছে- আমি শুধু এই জিনিসগুলোকেই রেখে দেব। 
তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি অবশ্যই আবেগের কাছে নতি শিকার করতে চাই না। 

বুধবার ২৯
আমার মনে হলো তাকে দেখতে যাওয়ার মাঝের বিরতির সময়টাতে আমি তাকে কিছুটা ভুলে গেছি। আজ তিনি বলছিলেন- ‘আমার মনে হয় ওটাকে জলের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে’। আমি জিজ্ঞেস করলাম- ‘কাকে, মা?’ 
তিনি বললেন, ‘ওই যে সোনালি মাছটা (গোল্ডফিশ), যেটা একদিন আমার হবে’। একটু পরে তিনি আবার বললেন, ‘আমার কি মনে হয় জানিস! আমার এই অবস্থা আর ভালো হবে না। আমি এমনই থাকবো’। একটু পরে আমি তাকে ছুঁয়ে দেখলাম, তার শরীর আর হাত দুটো মার্বেল পাথরের মতন ঠা-া হয়ে আছে। আর চোখ দুটোতে আছে ক্লান্তিকর উন্মাদ চাহনি।

সেপ্টেম্বর, সোমবার ৩
আমার ‘ক্লিনড আউট’ বইটা আগাগোড়া একবার পড়লাম, যেটা খুব শীঘ্রই পেপারব্যাক এডিশনে বাজারে আসছে। বইয়ের শেষের দিকে আমি তাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা রেখেছি সে সময়ের যখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর; সে বয়সে আমি তাকে যেমন দেখতাম, সেরকমটাই আঁকার চেষ্টা করেছি। ওইসব দিকে আমি তাকে ক্যুউবিক বলে ডাকতাম। 

বুধবার ৫
এই নার্সিংহোমের ভেতরে সারাবছর একই রকমের ঊষ্ণতা, তাপমাত্রা থাকে। যেন প্রকৃতিতে আর কোনো ঋতুই নেই। সমস্ত নারী রোগীদেরকে তাদের ফুলতোলা ডোরাকাটা গাউনে মনে হচ্ছে- তারা এক একটি ছোট্ট বালিকায় রূপান্তরিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনকে দেখা যাচ্ছে বেশ লম্বা, তিনি রানীসুলভ ভঙ্গিমা আর ধৈর্যশীলতায় কাঁধে একটি শাল ফেলে রেখে বসে আছেন- দেখতে লাগছে বেশ মনোমুগ্ধকর। আমার মনে হলো- তিনি যেন মার্সেল প্রুস্তের সেই ফ্রান্সিস। 
আমার মা আমাকে প্রশ্ন করলেন- “তোর বাড়িতে থাকতে একটুও বিরক্ত লাগে না?” যখন তিনি আমাকে এটা জিজ্ঞেস করলেন, আসলে তিনি তার নিজের কথাই যেন বোঝালেন। হায় ঈশ্বর! তিনি এতটাই বিরক্ত হয়ে আছেন! অথবা এই বিরক্তি শব্দটি তার সমস্ত তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। তিনি আসলে তার নিজের জীবন সম্পর্কে কতটুকু স্মরণ করতে পারছেন? এখন তার কাছে জীবন মানে কী? এখন আমার মায়ের কাছে জীবন মানে কী? 
    (চলবে...)

×