ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুরের জাদুকর কমল দাশগুপ্ত

জোবায়ের আলী জুয়েল

প্রকাশিত: ২২:১২, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

সুরের জাদুকর কমল দাশগুপ্ত

কমল দাশ গুপ্ত

কমল দাশ গুপ্ত সারা জীবনে প্রায় আটহাজার ৫০০ গানে সুরারোপ করে গেছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪০০টি নজরুল সঙ্গীত। অধিকাংশ গানই জনপ্রিয়তার অতুল শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর সুরের বৈচিত্র্য ছিল অবিশ্বাস্য। খেয়াল, রাগ প্রধান গান, ভজন, কীর্তন, কাওয়ালি, ইসলামী সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান, উর্দু ও হিন্দি গীত, গজল, লোকসঙ্গীত, মার্চ সঙ্গীত ও সিনেমার গানের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় সুরের ঝংকার। সংখ্যায়, বৈচিত্র্য ও গুণগত মান উৎকর্ষে সমগ্র উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে তাঁকে অতিক্রম করার মতো অবদান আর কোন সুরকারের নেই বলে অনেক সঙ্গীত বিশেষজ্ঞই মনে করে থাকেন।
এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে ঢুকে প্রায় ২৩ বছর বয়সে সঙ্গীত পরিচালনা ও গানের সুর করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। কমল দাশ গুপ্ত খুব কম সময়ের মধ্যে তাঁর নিরলস প্রতিভা ও নিষ্ঠার গুণে বাংলা গানের জগত ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে। তাঁর সুরের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন বলেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কমল দাশ গুপ্তকেই দিয়েছিলেন অনুমোদন ছাড়াই তাঁর গানের সুর করার অধিকার। তখন কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গানের প্রশংসা সকলের মুখে মুখে। বাংলার ঘরে ঘরে এসব গান তৎকালীন গ্রামোফোন যন্ত্রে যখন বাজত, শ্রোতারা তন্ময় মুগ্ধ হয়ে শুনতেন।
নজরুল আর কমল দাশ গুপ্ত তাঁরা দুজন ছিলেন যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একই বৃন্তে দুটি ফুল। হিজ মাষ্টার্স ভয়েসে কমল দাশ গুপ্ত এক মাসে ৫৩টি গান রেকর্ড করে সে সময়ে উপমহাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। রেকর্ড সংখ্যক গানে সুরারোপের জন্য ১৯৫৮ সালে এইচ.এম.ভি তে তাঁর সিলভার জুবিলি অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বাঙালীদের মধ্যে সর্বপ্রথম উর্দুভাষায় কাওয়ালি গেয়েছিলেন।
নজরুল ইসলাম ছিলেন গ্রামোফোন যুগে সফল গীতিকার। শুধু গীতিকারই নন, আধুনিক বাংলা গানের জনকও ছিলেন তিনি। সে যুগের সেরা কম্পোজার কমল দাশ গুপ্তকে (১৯১২-১৯৭৪ খ্রি.) নিয়ে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামোফোন কোম্পানিতে (১৯৩২ খ্রি.) এবং তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয় বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। কাজী নজরুলের স্নেহ ধন্য হয়ে ওঠা কমল দাশ গুপ্তের সঙ্গীত জীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এতে তাঁর সঙ্গীত জীবনের মোড় ঘুরে যায়।

নজরুলের কথা ও কমল দাশ গুপ্তের অসাধারণ সুর আর গায়কীর গীতি সুধায় সেদিন যে আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, তাঁর মূলেই ছিলেন কমল দাশ গুপ্ত এবং পরোক্ষভাবে প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরী, যুথিকা রায় ও জগন্ময় মিত্র। সুতরাং একথা একটু জোর দিয়েই বলা যায়, নজরুর পরবর্তী দশকে কমল দাশ গুপ্তের সুর আর প্রণব রায়ের কথাই ছিল বাংলা গানের প্রধান ধারা। বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেও কমল দাশ গুপ্ত প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।

তাঁর সুর দেয়া ও গাওয়া ‘তুফান মেল’ ‘শ্যামলের প্রেম’ ‘এই কিগো শেষ দান’ চলচ্চিত্রের গানগুলো একসময় বিপুল জনপ্রিয় ছিল। অনেক হিন্দি ছায়াছবিতেও তিনি দক্ষতার  সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তিনি প্রায় ৮০টি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। উল্লেখ করা যেতে পারে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দু ফৌজের ‘ম্যাচিং সং’-এর সুর তাঁরই দেয়া। এছাড়া তিনি সুর দিয়েছেন হায়দরাবাদের নিজামের গোল্ডেন জুবিলির বিশেষ সঙ্গীতেও ভারতীয় রণসঙ্গীতে ‘কদম কদম বারহায়ে যা’ গানে।
কমল দাশ গুপ্ত গ্রামোফোন কোম্পানিতে প্রথম জীবনে একজন তবলা বাদক হিসেবে প্রবেশ করে বাজাতেন ম্যান্ডেলিনি ও জাইলোফোন। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি, মৌলিক প্রতিভা ও অসামান্য মেধা তাঁকে অচিরেই খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। তাঁর রক্তে যে গান ছিল তা মসৃণ হয়েছে নজরুলের সান্নিধ্য পেয়ে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তিনি শুধু বাংলা ভাষায় নয়, হিন্দি, মারাঠি, তামিল, উর্দু প্রভৃতি ভাষার গানেও সুরারোপ করেন।

নজরুল ইসলামের গান তাঁর ভিত গড়ে দিলেও প্রণব রায়, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, শৈলেন রায়, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিল ভট্টাচার্য রচিত গানে সুর সৃষ্টির মাধ্যমে কমল দাশ গুপ্ত শুধু জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি, সৃষ্টি করেন বাংলা গানের একটি নতুন ধারা। তিনি বাংলা ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চারবার ও হিন্দি ছবির জন্য একবার মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর শেষ ছবি ‘বধূবরণ’। সমগ্র উপমহাদেশে সঙ্গীত জগতে তিনি ছিলেন অবিস্মরণীয় প্রতিভাধর সুরকার।
প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম তৎকালীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে থাকতেন। সঙ্গীতের প্রয়োজনে কলকাতাতে প্রায়ই যাওয়া আসা ছিল তাঁর। সে ধারাবাহিকতায় তিনি কমল দাশ গুপ্তের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর কাছে গান শেখার সুযোগ লাভ করেন। ধীরে ধীরে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে এবং শিল্পী ফিরোজা বেগম মনেপ্রাণে কমল দাশ গুপ্তকে ভালবাসতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালে উভয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন কমল দাশ গুপ্তের বয়স ছিল ৪৩ বছর। বিয়ের চার বছর পরে ৪৭ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর নাম হয় কাজি কামাল উদ্দিন।

কলকাতায় তাঁদের তিন সন্তান তাহসীন, হামিন ও শাফিনের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালে কমল দাশ গুপ্ত সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে। কিন্তু ঢাকায় আসাটা যেন কমল দাশ গুপ্তের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এখানে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গীতকে তিনি ঢেলে সাজাবেন কিন্তু কার্যত তা’ সম্ভবপর হয়নি। ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার দরুন তদানীন্তন পাক-ভারত দু’দেশেই তিনি হয়ে পড়েন বেশ উপেক্ষিত। আমাদের লজ্জা ও দায় এই যে, কমল দাশ গুপ্ত একসময় প্রচ- দারিদ্র্যতার দরুন ঢাকার হাতিরপুলে ‘পথিকার’ নামে একটি মুদিখানার দোকান খুলেছিলেন।
জীবনসায়াহ্নে অল্প কিছুদিন বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে  কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করেন। বলা যায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এটি একটি মহৎ কাজ।
এই বরেণ্য কৃতীশিল্পী কমল দাশ গুপ্ত যৌবনে ১৯৪৬ সালে সরকারকে সাইত্রিশ হাজার টাকা আয়কর দিতেন। মোটর গাড়ি ছাড়া কখনই চলতেন না। সেই কমল দাশ, যূথিকার প্রেমের প্রত্যাখ্যান, পারিবারিক সঙ্কট ও নাথ ব্যাংকে লালবাতি জ্বলায় নিঃস্ব পুঁজি হারিয়ে একেবারে রিক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর বাড়ির বিশ্বস্ত ভৃত্য অবশিষ্ট যেটুকু জমি তাঁর ছিল তাও নিয়ে বিক্রি করে একদিন উধাও হয়ে যায়। আর্থিক ও মানসিকভাবে কমল দাশ গুপ্ত সর্বহারা ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এ এক নিয়তির নির্মম পরিহাস।
১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই বঙ্গদেশের একজন বরেণ্যকৃতী শিল্পী ও সুরকার কমল দাশ গুপ্তকে অনাদারে অবহেলায় একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৬২ বছর বয়সে (১৯১২ খ্রি.-১৯৭৪ খ্রি.) নীরবে বাংলাদেশ থেকে চিরবিদায় নিতে হলো। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে যখন তাঁকে পোষ্ট গেজেটেড মেডিক্যাল হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট অথবা একটি কেবিনে ভর্তি করার জন্য তাঁর অনুরাগী ও স্বজনরা সরাসরি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের অনুরোধ করতে থাকেন। তখন তারা বারবার জিজ্ঞেস করছিল যে কমল দাশ গুপ্ত একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা কি না।

সবাই বলছিলেন সঙ্গীতের এই গ্র্যান্ড মাস্টারকে অবহেলা করবেন না। এখনই দ্রুত চিকিৎসা দেন। কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তাররা বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন একই কথা। তিনি ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার কি না? সেই অসাধারণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই কমল দাশ গুপ্ত ছেড়ে গেলেন এই পৃথিবীর মায়া। কমল দাশ গুপ্ত বাংলা সঙ্গীতের এক অবিস্মরণীয় নাম সঙ্গীতের মুকুটহীন স¤্রাট। এই সঙ্গীতবোদ্ধা সঙ্গীতে রেখে গেছেন তাঁর উত্তরসূরি হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদকে। দুজনই বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা।

×