ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ॥ শতবর্ষের নতুন ভাবনায়

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ৮ জুন ২০১৮

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ॥ শতবর্ষের নতুন ভাবনায়

বাংলা কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমন মোটামুটি তিরিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেই তিরিশের প্রতাপশালী কলোলকেন্দ্রিক আন্দোলন স্তিমিত হলেও প্রবোধ সান্ন্যাল, বুদ্ধদেব বসু ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-এর মতো খ্যাতিমান লেখক-কবিরা তখনও দারুণ সক্রিয় রয়েছেন, রয়েছেন আরেকজন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত। শক্তিশালী লেখক হওয়া সত্ত্বেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তুলনামূলকভাবে কম পাঠকই পেয়েছেন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন মাত্র আটচলিশ বছর বয়সে। পাশাপাশি সমালোচিত হয়েছেন তার অনড় (কিছুটা রক্ষণশীলও বটে) আদর্শগত অবস্থার কারণে। প্রথম পর্বে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যতটা অসামান্য, তুখোড়, ঝাঁঝালো ও সৃজনশীল, দ্বিতীয় পর্বের লেখক হিসেবে তিনি কেমন যেন অর্থাৎ এই পর্বের লেখক হিসেবে তার সৃজনশীলতার পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। ছোট গল্পকার হিসেবে তার সাফল্য আকাশচুম্বী হলেও এখন অবধি তাকে আমরা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কিংবা ‘পুতুল নাচের ইতিকথার’ মতো অবিস্মরণীয় উপন্যাসের অমোঘ স্রষ্টা হিসেবে স্মরণে রেখেছি। অথচ তার বাহিরেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও ভাল কিছু উপন্যাস রয়েছে। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রকাশকরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’তিনটি উপন্যাস বার বার ছাপছেন। এগুলো মোটামুটিভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পর্বের লেখা। পরবর্তীকালের গল্প-উপন্যাস নিয়ে মানিক সমালোচকরা বেশ নীরবও বটে। হতে পারে এসব লেখা সমালোচকদের খুব একটা আকর্ষণ করে না। এমনকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ- ভক্ত সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন-এই বলে যে, ‘শহরতলী’ উপন্যাসের পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তেমন নজরকাড়া উপন্যাস লিখতে পারেননি। অবশ্য বামপন্থী সমালোচক মালিনী ভট্টাচার্য কিংবা কথাকার-সমালোচক দেবেশ রায় সরোজের এই মন্তব্য মানতে নারাজ। আবার এটাও ঠিক যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু তার মতবাদ বহির্ভূত সমালোচকদের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন এমনটা নয়, কট্টর বামপন্থীরাও তাকে গ্রহণ করতে পারেননি। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো চলিশের কবি সমর সেন। তিনি ১৭-১০-৪২ সালে বুদ্ধদেব বসুকে এক চিঠিতে লিখেছেন : “এই সংখ্যায় আনন্দবাজারে মানিক বাবুর ‘শহর বাসের ইতিকথা’ ও আর একটি উপন্যাস চতুষ্কোণ পড়লাম। দুটোই বাজে মনে হলো। মানিক বাবু বাঙালী বুর্জোয়াদের সম্বন্ধে লিখতে শুরু করে কেলেঙ্কারী করেছেন।” [পুলক চন্দ সম্পাদিত অনুষ্টুপ- সমর সেন সংখ্যায় : দ্বিতীয় সংস্করণ] পাশাপাশি সমালোচক অশ্রুকুমার শিকদার প্রশ্ন করেছেন এই বলে : “কিন্তু কেন এই ব্যর্থতা কেন দশ বছরের মধ্যে চব্বিশ থেকে চৌত্রিশ বছরের মধ্যে তীব্রভাবে জ্বলে উঠে ফুরিয়ে গেলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরুষময় সাহিত্য জীবন?” এখানে কার মতামত কতখানি ঠিক-বেঠিক সেই পর্যালোচনায় আমরা যাব না। কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘজীবী হলে এই বিষয় সম্পর্কে মতামত দেয়া সম্ভব হতো। দুর্ভাগ্যবশত মোটেও সেটি সম্ভবপর হয়নি। তবে এটা ঠিক যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভা বলতে গেলে এক অস্বাভাবিক প্রতিভা। তার প্রতিভার অস্বাভাবিকতা প্রথম লক্ষ্য করেছেন অগ্রজ কথাকার। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। আর তাই স্বয়ং প্রেমেন্দ্র মিত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন তার প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে দেরি লাগবে। কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের সব কিছুকে বিপরীত দিক থেকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। সাহিত্যিক হিসেবে ছিলেনও তাই। তবে একথা ঠিক যে, তার সাহিত্য কখনও একধারায় অগ্রসর হয়নি। কখনও ফ্রয়েডীয়, আর ক্ষণকালের জন্য ফ্রয়েডীয় ধারার পাশাপাশি চলেছে রাশিয়ার প্রখ্যাত পাবলোভের প্রভাবে লিখলেন গল্প ‘লেভেল ক্রসিং’, পরে এই গল্পকে কেন্দ্র করে রূপান্তরিত করে সৃজন করলেন আর একটি উপন্যাস ‘আরোগ্যা’। আমার কেন যেন মনে হয় মানিক সমালোচকরা এই উপন্যাসটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। সুবিচার পেলে এটির ওপর বিস্তর সমালোচনা-আলোচনা হতো। সেই রকম কোন কিছু হয়নি। তবে এটা সত্য যে, খেয়াল করে দেখা গেছে, প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বের গল্প-উপন্যাস অনেকখানি পানসে ও শিল্পের দাবি খুব একটা মেটেনি। সেই কারণে প্রকাশকরা এই সমস্ত গল্প-উপন্যাস একবার ছাপানোর পরে তাদের আগ্রহের অভাবে পাঠকদের কাছে সহজলভ্য হয়নি। চিন্মোহন সোহানবীশ-এর মতো খ্যাতিমান সমাজবাদী সমালোচক মনে করতেন যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজবাদী হওয়াটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিল। আসলে তিনি পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। মানিক-পরবর্তী অনুজ গল্পকার ও ঔপন্যাসিক অসীম রায়ও তার একটি লেখায় এই মতকে সমর্থন করেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম শত বর্ষের পরে আমাদের কয়েকটি জরুরী প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া একান্ত জরুরী। আদর্শ কি একটা লেখকের জন্য ক্ষতিকর? ক্ষতিকর হলে অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল করেছিলেন। ভুল করেছিলেন মার্কসবাদী ধারায় সাহিত্য সৃজন করে। তবে আমার এই মন্তব্যে অনেকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন এই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তো তার সাহিত্যে আগাগোড়া মানুষের কথা বলে এসেছেন। সেই ক্ষেত্রে মার্কসবাদী ধারায়ে সাহিত্য রচনাকালে সেটা কি দোষবহ হবে? শ্রদ্ধেয় মানিক গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ সেটাকে দোষণীয় বলেননি। তিন এই মন্তব্যের সমর্থনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র নাম টেনে এনেছেন। এখন আমাদের বিবেচনা করা দরকার- আদৌ এই মন্তব্য সঠিক কিনা? আমার বিবেচনায় সেই মন্তব্য আদৌ ঠিক নয়। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা খুব সুন্দর করে ধরেছেন বটে, আসলে এই উপন্যাস সত্যিকার অর্থে রহস্য উপন্যাস। আর এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরকীয়া প্রেমকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কুবেরের চরিত্রের মধ্যে কোন ধরনের আদর্শবাদিতা নেই। তাহলে পাঠক সরাসরি প্রশ্ন করতে পারেন এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কোন আদর্শের কথা প্রচার করেছেন? সেই তুলনায় তার পরবর্তী উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ অনেকটা সার্থক অবিস্মরণীয় উপন্যাস। এই উপন্যাসে সামাজিক জীবনের চেয়ে ব্যক্তি জীবন যন্ত্রণার কথা বেশি ব্যক্ত করেছেন। এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরকীয়া প্রেমের বিষয়ে অনেক বেশি হয়েছেন, কারণ উপন্যাসের প্রধান কুশীলব শশী বুঝতে পারেননি, অসুস্থ পরানের বউ কুসুম তাকে ভালবাসে। বুঝতে পারলেন শশী যখন আর কুসুমকে ফেরানোর কোন উপায় ছিল না। সত্যি বলতে কি এটি শরৎ-পরবর্তী একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। কারণ উপন্যাসের নায়ক শশীর মামলাবাজ হওয়ার ঘটনাটাই প্রমাণ করে বিধাতার হাতে সদাসর্বদা মানুষ একজন পুতুল মাত্র, যাকে তিনি সব সময় নাচিয়ে বেড়াচ্ছেন। আসলে এটাই মানুষের জীবনের বাস্তবতা। এই উপন্যাসের বহু সংস্করণ হয়েছে, উপন্যাসে ঔপন্যাসিক যে ক্ষমতার প্রমাণ করেছেন তারও প্রশংসা করেছেন সমালোচকরা। কিন্তু কোন সমালোচনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। তিনি মনস্থ করেছিলেন আলাদাভাবে এই উপন্যাস বিষয়ে স্বয়ং কিছু লিখবেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাছ-থেকে এ রকম মতামত সংবলিত লেখা পাইনি। এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আন্তঃবাস্তবতার আশ্চর্য শক্তি প্রদর্শন করেছেন। তবে আমি শ্রদ্ধেয় সমালোচক নারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে একমত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যিকারভাবে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো অনেকটা অনালোচিত ‘শহরতলী’। দু’খ-ে (আরও এক খ- লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পারেননি) সমাপ্ত দীর্ঘ এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ নির্ভার নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের আশা-ভরসার দিকটি তুলে ধরতে পেরেছেন। অথচ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখনো কমিউনিস্ট হননি। উপন্যাসটির নায়িকা যশোধারার সঙ্গে আমাদের এই উপলব্ধির বাস্তবতা মানতে বাধ্য করে যে, ভারতবর্ষ এখনও শ্রমিক-বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত নয়। অথচ বিস্ময়ের বিষয় এই যে, এই উপন্যাসটি তেমন পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। আমাদের কল্পনা করতে বাধা থাকে না যে আনন্দবাজারে শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস ছাপানোর রেওয়াজ শুরু হয়েছিল এই ‘শহরতলী’ উপন্যাসের মধ্য দিয়েই। ঐ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গল্প ‘ল্যাবরেটরী’ পাশাপাশি বেরিয়েছিল। তাহলে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানিকের ঐ ‘শহরতলী’ উপন্যাস পাঠ করেছিলেন। এই সৌভাগ্য আমাদের খুব কম সাহিত্যিকের হয়েছে। এর পরেও প্রতি বছরই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস (তার উপন্যাসের সংখ্যা ৪২টি)। বেরিয়েছে। তবে এসবগুলো ছিল অধিকাংশই নভেলা জাতীয়। এই তালিকায় আমি তার ‘অহিংস’ আনছি না। আমি আগেই বলেছি যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্বের সাধনা মার্কসবাদী চেতনায় দীক্ষিত হলেও গল্প রচনায় তেমন কোন ভাটা পড়েনি। এই পর্বে আমরা পেয়েছি ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’র মতো অসম্ভব সুন্দর গল্প, যেটা পড়ে আমাদের মনেই হয় না আদৌ এটা এক ধরনের উদ্দেশ্যবাদী গল্প। আমাদের মনে রাখতে হবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ব্যর্থতার জন্য বলতে বাধা নেই, দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারিÑ কেবল তিনিই দায়ী নন, দায়ী আমাদের সমাজব্যবস্থাও বটে। তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য আলোচনায় দেখা দিয়েছে আরেক রাজনীতি। যারা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর গবেষণা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর পড়ান, তারা আমাদের এটা বোঝাতে চান যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া নিম্নবিত্তদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে তেমন কেউ ভালো গল্প-উপন্যাস লিখেননি। যদিও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তবুও আদর্শগত কারণে তৎকালীন অনেক কবি-সাহিত্যিকদের বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন। এমনকি কবি বিষ্ণু দে’র সঙ্গে লেখনীর বাক-বিত-ায় লিপ্ত হয়ে যান। যদিও বিষ্ণু দে একজন মানিকভক্ত পাঠক। মানিকের সমালোচনার কোপানলে পড়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, এমনকি কথাকার শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তাদের বিরুদ্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ হলো তারা তাদের গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাস্তববাদী চেতনা থেকে দূরে সরে গেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সমকালীন আরেকজন প্রখ্যাত লেখক সুবোধ ঘোষকে আক্রমণ করে ‘হ্যাংলা’ নামে একটি ছোট গল্প লিখে ফেললেন। আসলে এটি হলো প্রতিভাবানদের স্মরণীয় আদর্শবাদীদের বিধিলিপি যা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী কথাকারও এড়িয়ে যেতে পারেননি। গরিব-দুঃখীদের ওপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ধরনের স্থায়ী দরদ ছিল। এই দরদ কোন কোন সময় মাত্রা অতিক্রম করে গেছে তা স্বীকার করতে দ্বিধা থাকে না। অতি সম্প্রতি কয়েকজন সমাজবাদী সমালোচক-লেখকের লেখা পড়লে মনে হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। এটা ঠিক যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সমকাল অতিক্রম করে গেছেন সময়ের দাবি মিটিয়ে দুর্ভিক্ষের ওপর কিছু অসামান্য ছোটগল্প লিখে মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন তা তাকে স্মরণীয় করে রাখবে। আবার প্রথম পর্বের লেখা ছোটগল্প ‘সরীসৃপ’ এর মানিককে দ্বিতীয় পর্বের মধ্যে খুঁজতে গেলে অবশ্যই ব্যর্থ হতে হবে। কারণ শিল্প-সাহিত্যে কখনা কখনও স্রষ্টাকে তার সৃষ্টিকে অতিক্রম করে যায়। আর এটা স্বাভাবিক যে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সত্তার পরিবর্তন ঘটে যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, সমাজবাদী সমালোচকরা ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পর্বের গল্প-উপন্যাস নিয়ে আগ্রহবোধ করেন না। আবার ফরমাইসী সমালোচনাও মানিক সমালোচনাকে দুর্বল করে ফেলেছে। যেমন সরদার ফজলুল করীম ‘চেতনায় অনন্য শিল্পী’ শিরোনামের প্রবন্ধটির উল্লেখ করা জরুরী, প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে, ‘ভূঁইয়া ইকবাল’ সম্পাদিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলনে। এই লেখায় তিনি জানিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃজনশীলতা সম্বন্ধে না জানালেও কেবলমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লেখকের কথা’ প্রবন্ধ গ্রন্থ পড়ে প্রবন্ধ লিখে ফেললেন। তারই জন্য বলছিলাম, এর কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। তবুও শেষাবধি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য বৈচিত্র্য আমাদের এখন অবধি অমোঘ আকর্ষণ করে। একটি উদাহরণ পেশ করা যাক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ঘোরতর কমিউনিস্ট, তার আগে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রতিবিম্ব’ নামে একটি উপন্যাস। ‘চতুষ্কোণ’ প্রকাশ হওয়া মাত্রই আবার বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক বিরোধীরা বলতে লাগলেন, মানিকের গল্প-উপন্যাসের যেহেতু বাজার নেই, সেই কারণে যৌনতার মাল-মসলা দিয়ে বাজার ফেরানোর চেষ্টা করছেন। সমাজবাদী সমালোচকদের ধারণা যে, কমিউনিস্ট হলেও ‘চতুষ্কোণ’ এর মতো উপন্যাস লেখা একেবারে নাজায়েজ কাজ। কিন্তু প্রজ্ঞাবান সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুব বিরোধীদের সমস্ত মতামত খ-ন করে লিখলেন : লেখকের বিন্দুমাত্র অসাবধানতার ফলে ঠঁষমধৎরঃু দিকে ঝুঁকে পড়তে তা সহজেই, যে সমস্ত অধ্যায়টি আমি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে পড়েছি, প্রতি ছত্রে আশঙ্কা জেগেছে, এই বুঝি সব গেল। কিন্তু পাকা শিল্পীর মতো জাত মুহূর্তের জন্য কাঁপেনি। কোন রেখাও বেঁকে যায়নি। কোন রঙও একটুও বেশি পড়েনি। [সাহিত্যে যৌন প্রসঙ্গে ও বর্তমান সমাজ : পথের শেষ কোথায়- পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১০২] আমি খুঁজে পেতে দেখলাম জনাব আবু সয়ীদ আয়ুবের প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’ সাহিত্য পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় (আশ্বিন-১৩৪৯) প্রবন্ধটির নিচে ফুটনোট আকারে সম্পাদকের মতামতও জুড়ে দেয়া হয়েছিল এই বলে, ‘এই মতামত প্রবন্ধকারের মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নহেন।’ তাহলে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বিতর্কের বেড়াজালে সম্পাদক হুমায়ুন কবীর সাহেব জড়াতে চাননি। কারণ তখনও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসটির বিষয়বস্তু অনেকে গ্রহণ করতে পারেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে উপন্যাসটি পাঠ করার পর- তেমন সেই রকম মনে হয়নি, কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসে গল্পের প্রধানতম কুশীলবদের মানব-মানবী হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। আমি এই বিষয়ে সমাজবাদী সমালোচক রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত : চলিশ দশকেও ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ সংক্রান্ত যৌন-মানসের ছবি এঁকেছেন। সেখানেও অবক্ষয়ীরা যেভাবে যৌনতাকে সর্বময় করে সমগ্র জীবনসত্যকে খ-িত করতে চেয়েছে সেই রকম কিছু করেননি তিনি। [মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কম্যুনিষ্ট : অতি আধুনিকগণ কথাশিল্পী দীনেশ দাশ গুপ্ত-শান্তি স্বাধীনতার সমাজতন্ত্র- এপ্রিল-১৯৭৮] তবে এই প্রবন্ধের শিরোনামেও রণেশ দাশগুপ্ত একটু বেশি মাত্রায় মানিক ভক্তের পরিচয় দিয়েছেন, কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক ছিলেন, তবে অতি আধুনিক নয়, একমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই এই উপন্যাস লেখা সম্ভবপর ছিল- কারণ আমরা এই ধরনের বিষয় কেন্দ্রিক উপন্যাস মানিক পরবর্তী ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকে পাইনি। সেইদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এটি একটি দুর্বলতম রচনা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সমাজবাদী হলেই কি লেখক খারাপ লেখেন নাকি? বস্তুত তা নয়। আমাদের কথাসাহিত্যে এমন অনেক সমাজবাদী কথাসাহিত্যিকের অস্তিত্ব রয়েছে, যারা সমাজবাদে থেকেও ভাল লিখে গেছেন। যদিও শ্রদ্ধেয় সমালোচক অশ্রু“কুমার শিকদার মনে করতেন- “১৯৪৯-৫০ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অতি বাম বিচ্যুতি ও তার প্রবণতার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছিলো তথাকথিত প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনে এবং নিষ্ঠাবান পার্টি কর্মী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে। (ব্যক্তি মানস ও লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)” এর পরেই তিনি দাবি করেছেন এই বলে “১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রবল চাপে ছিলেন না বলেই ‘চতুষ্কোণ’ এর মতো স্মরণীয় উপন্যাস লিখতে পেরেছিলেন।” [মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়তি, অশ্রু কুমার শিকদার- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়- ইকবাল ভুঁইয়া সম্পাদিত] মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এক লেখায় স্বীকারও করেছিলেন তার লেখা ক্রমান্বয়ে প্রচারধর্মী হয়ে পড়েছে, এর জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন দুঃখবোধ ছিল বলে মনে হয় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝে মাঝে এই প্রচারধর্মীতার বেড়াজালে বন্দী হয়ে পড়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, কোন প্রকার সুভাষণ ছাড়াই ‘পুতুল নাচের ইতিকথাই’র মতো উপন্যাস সফল করে তুলেছিলেন। কিন্তু তার অনেক পরের নাতিদীর্ঘ উপন্যাস ‘ইতিকথার পরের কথা’তে অসংখ্য সুভাষণ থাকলেও উপন্যাসটিতে সফলতা উপার্জিত হয়নি। স্বয়ং মানিক সমালোচক অচ্যুৎ গোস্বামী স্বীকার করেছেন দ্বিতীয় পর্বের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি উপন্যাস সম্পর্কে এই মন্তব্য করা যায়। এর পরেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীমালা তার পরবর্তী অনুজ কথাকারদের প্রভাবিত করে চলেছে ক্রমান্বয়ে।
×