ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

অন্যকে সাজিয়ে আনন্দ

লিখন আহমেদ

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১৯ জুন ২০২৫

অন্যকে সাজিয়ে আনন্দ

নারী শুধু হাঁড়ি সামলাতেই জানে না। এখনকার নারী আর সে যুগের নারীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। একসময় নারীরা ঘরে আবদ্ধ থেকে সংসার সামলাতেন। এখনকার নারীরা সংসারের পাশাপাশি কর্মদক্ষতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। নারীরা পরিবারে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে এখনো শহরের এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের নারীদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েই গেছে। গ্রাম অঞ্চলের নারীরা এখনো শহরের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশের প্রত্যন্ত গ্রামঅঞ্চলের নারীদের নানান প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নানান বাধার সম্মুখীনও হতে হয়। এত কিছুর মধ্য দিয়েও অনেক নারীই নিজ প্রচেষ্টায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে আবার অনেকে অন্যকেও প্রতিষ্ঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করছে।
তেমনি এক সংগ্রামী নারী সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার শিপ্রা রানী (স্মৃতি)। পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার নন্দনপুরে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারে দুই ভাই বোনের মধ্যে স্মৃতি বড়। ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর স্মৃতির বিয়ে হয় উল্লাপাড়ার ঘোষগাতি গ্রামের মনোরঞ্জন পালের ছেলে চন্দন কুমার পালের সঙ্গে। বিয়ের পর আর লেখাপড়ার দিকে ঘুরে তাকানো হয়নি তার। তবে নিজ গুনে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন তিনি।
ছোট বেলা থেকে নিজের মধ্যে একমাত্র গুন বলতে ছিল রূপচর্যা করা। নিজে সাজতেন অন্যকেও সাজাতেন। সে সময় গ্রামের কারও বিয়ে জন্মদিন কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে স্মৃতি অন্যকে সাজিয়ে দিতেন। এই গুনই একসময় তার সফলতার সিঁড়ি হয়ে দাঁড়াবে তা কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। বিয়ের পর পরিবারের কাজকর্ম এবং সংসার সামলানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি।  দেশে করোনার আবির্ভাবের কিছুদিন পূর্বে তাদের পারিবারিক একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ভারতের বালুর ঘাটের প্রতাপ সিং নামে এক মেকাপ আর্টিস্ট তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন এবং বিয়ের কনেকে সাজিয়ে দেন। একজন পুরুষ মানুষ এতো সুন্দরভাবে মেকাপ আর্টিস্টের কাজ করছে এটা দেখেই মূলত স্মৃতির বিউটিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন জাগে। তার এক নিকট আত্মীয়ের দেওয়া একটি মেকাপবক্স দিয়ে নতুন শুরু করেন অন্যকে সাজানোর কাজ। প্রথম দিকে ঘোষগাতি ও আশপাশের গ্রামের মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে  মেয়েদের সাজিয়ে দেন। বিনা পারিশ্রমিকে কাজ শুরু করেন তিনি। স্বামীর দেওয়া হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে সরঞ্জামাদি কিনে টানা দুই বছর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ চালিয়ে যান। শুরুর দিকে পাড়া প্রতিবেশীর কটাক্ষ আর তিরস্কার স্মৃতিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর পুরোদমে কাজে নেমে যান তিনি। তার সফলতার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান স্বীকার করেন উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিনের প্রতি। 
মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রশিক্ষণের পর পুরোদমে কাজ শুরু করেন তিনি। নিজের বাড়ির একটি কক্ষে নিজ নামে একটি বিউটি পার্লার গড়ে তোলেন।  সেখানেই তিনি তার প্রতিভা কাজে লাগাতে শুরু করেন। দেশি-বিদেশি ট্রেইনার থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণ নিজের আন্তরিকতা ও সুদক্ষ কাজের মাধ্যমে অল্প দিনেই স্মৃতি বিউটি পার্লারটি নারীদের কাছে অতি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেখানে স্মৃতি বিউটিশিয়ানের কাজের পাশাপাশি সম্ভাবনাময়ী নারীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত তিনি অন্তত পঞ্চাশ জন নারীকে বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। 
স্মৃতি বলেন, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার পর সংসার শুরু করি। কখনো মনে করিনি আমি একজন উদ্যোক্তা হব কিংবা আমার হাত ধরে কেউ সফল হবে। সেই ছোট বেলা থেকে নিজে সাজুগুজু করতাম, সেই শখই আজ পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার আগে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে সাজিয়ে দিতাম। প্রথম দিকে বিষয়টা অনেকেই ভালোভাবে নিত না তবুও থেমে থাকিনি। স্বামীর দেওয়া হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে সরঞ্জামাদি কিনে মানুষকে সাজিয়ে দিতাম। এরপর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রফেশনাল বিউটিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেছি। প্রথম দিকে তেমন সাড়া না পেলেও পরবর্তীতে সবার মনে স্মৃতি বিউটি পার্লার স্থান করে নিয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এখন আমি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। অন্যান্য নারীদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।  মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, স্মৃতি একজন সম্ভাবনাময়ী নারী। আমরা প্রথম থেকেই তাকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করেছি। অনেক সংগ্রাম করে স্মৃতি আজ এ পর্যায়ে এসেছে। স্মৃতির মতো অন্যান্য নারীদেরও উদ্যোক্ত হতে আমরা প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ প্রদান করছি।

প্যানেল

×