ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ঘুরে আসুন ছৈলারচর

জলি রহমান 

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ২১ মে ২০২৩

ঘুরে আসুন ছৈলারচর

ছৈলারচর পর্যটন স্পট

ভ্রমণপিপাসু মানুষগুলো সুযোগ পেলেই ছুটে যায় প্রিয় কোনো জায়গায়। সকল কাজকে ছুটি দিয়ে মনের শান্তি খুঁজতে কখনো বিদেশে আবার কখনো দেশেই খুঁজে নেয় নান্দনিক স্থান। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা নদী-মাতৃক এ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। যা হয়তো এখনো অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়নি। আবার কর্মব্যস্ততার জন্য ঈদের ছুটি ছাড়া বছরের অন্য সময়ে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয় না অধিকাংশ মানুষেরই। আর এ কারণেই  ঈদের সময়ে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল-মোটেল থাকে লোকে লোকারণ্য। এমন কি প্রত্যন্ত অঞ্চলের পর্যটন স্পটেও থাকে মানুষের ভিড়। এবার রোজার ঈদে সুযোগ হয়েছিল এমনই একটি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার। সেখানে যাওয়ার পরে রবিঠাকুরের ‘একটি শিশির বিন্দু’ কবিতার লাইন দুটি খুব মনে পড়েছিল- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’ 

বহু বছর পরে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ভাবছিলাম কোথায় যাব! যেখানে সবাই আনন্দ পাবে এবং বাচ্চারাও উপভোগ করতে পারবে। তখনই এক বাল্য বন্ধুর পরামর্শে চলে গেলাম ছৈলারচর নামক একটি পর্যটন স্পটে। যা ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার হেতালবুনিয়ায় গড়ে উঠেছে। বরিশাল বিভাগের অন্যতম প্রধান বিষখালী নদীতে জেগে ওঠা এক বিশাল চর। বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে প্রায় ৬১ একর জায়গা নিয়ে এর অবস্থান। প্রথমে চিন্তা করেছিলাম, এই অজোপাড়াগাঁয়ে কি এমন দৃষ্টিনন্দন জায়গা হবে যা দেখলে ভালোলাগবে। সকল চিন্তা ভাবনার ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল বাস্তব দৃশ্যটা। প্রথম দর্শনে মনে হলো কোনো সমুদ্র তীরে এসেছি। এরপরে যত দেখেছি চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। যেদিকে দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। হরেক রকম টং ঘর, দোলনা, স্লাইডসহ শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা আয়োজন। 
ঢোকার পথেই নাগর দোলার কট কট শব্দ এবং শিশু-কিশোরদের হৈ-হুল্লোড়ে মনে হলো কোনো শিশু পার্কে এসেছি। রয়েছে বিশাল এক মাটির কেল্লা, সুসজ্জিত ডিসি লেক এবং মুক্তিযোদ্ধা ইকো পার্ক। সেখানে কয়েকঘণ্টার জন্য গেলে অতৃপ্তি বাড়বে। কমপক্ষে এক-দুদিনের সময় নিয়ে বেড়ানো প্রয়োজন। যাওয়ার রাস্তার দুপাশ শুধু সবুজ দিয়ে ঘেরা। প্রচুর ছৈলাগাছ থাকায় জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছে ছৈলারচর। এছাড়াও বট, মাদার, হোগল ও কেয়াসহ নানান গাছে ভরা এ স্থান। পর্যটকদের জন্য রয়েছে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দুটি রেস্ট হাউস। যে কেউ সেখানে ন্যূনতম খরচে পেতে পারেন অবারিত ভালো লাগা। গ্রামের রাস্তাগুলো এখন আর কাঁচা নেই। চারদিকে সবুজ তার পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ। এর মধ্যে আঁকা-বাঁকা নদীর মতো পাকা রাস্তা। পাশেই দেখা যায় ছোট-বড় কাঁচা-পাকা বাড়ি। গ্রীষ্মকালের তাপপ্রবাহের ছোঁয়া নেই ছৈলার চরে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যে কোনো ঋতুতেই আরামদায়ক হবে এই ভ্রমণ। তবে সেখানকার দোকানের কিছু লোক বলল- বৃষ্টির দিনে পর্যটকের সংখ্যা অনেক কমে যায়। কাদা-পানির ভয়ে মানুষ যেতে চায় না। কিন্তু বৃষ্টি বিলাস কার না ভালো লাগে। তাই বর্ষার সময়েও ছৈলারচর হতে পারে ভ্রমণের উপযুক্ত স্থান। শীত মৌসুমে ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা ও বেতাগীসহ বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছৈলারচরে আসে বনভোজন করতে। ইট-পাথরের শহর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে প্রকৃতিপ্রেমীরা বেড়িয়ে আসুন ঘন বন আর সবুজে ঘেরা ছৈলার চরে। নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য রয়েছে নান্দনিক বিশ্রামাগার। নদীর পাড়ের বাধনহারা বাতাসে বুঝতেই পারবেন না বিশ্বের বৃহত্তম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত নাকি সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা, কোথায় আপনি অবস্থান করছেন। প্রকৃতির মাঝে পড়ন্ত বিকেলের এক কাপ কফিতে প্রাণ ভরে যায়। উপভোগ করা যায় পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়ার দৃশ্যও। 

অসম্ভব এক ভালো লাগা কাজ করে হুহু করে বয়ে চলা বাতাসে। স্বেচ্ছাসেবী একদল যুবক সেখানে সার্বক্ষণিক তদারকির কাজ করছে। বিশ্রামাগার দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত এক যুবক মো: সাগর আকন জানালো, ‘এখানে শুরু থেকেই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছি। যারা বিশ্রামের জন্য আসে তারা মাঝে মধ্যে খুশি হয়ে কিছু বকশিশ দেয়। তা দিয়ে সংসার চলেনা। তবুও ভালোলাগা থেকেই কাজ করছি।’ বহু লোক এখানে আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে নিজ উদ্যোগে নানা ধরনের দোকানের মাধ্যমে। জানা যায়, প্রতিদিন ৪০০-৫০০ লোক ঘুরতে আসেন। বিভিন্ন ছুটির সময়ে পাঁচ-ছয় হাজার পর্যটক আসা-যাওয়া করেন। ছৈলারচরের পরিচিতি আরও বাড়লে দূর-দূরান্ত থেকেও ভ্রমনকারীরা আসবে বলেই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর। 
কাঠালিয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুফল চন্দ্র গোলদারের উদ্যোগে এডিবির অর্থায়নে নানা মাত্রিক উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে ছৈলারচরে। প্রশাসনিকভাবে ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এখনও বিভিন্ন কাজ হচ্ছে। স্থল ও নৌ দুটি পথেই যাওয়া যায় ২০১৫ সালে চিহ্নিত এই পর্যটন কেন্দ্রে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এ রকম আকর্ষনীয় অনেক জায়গা। যথোপযুক্ত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে এগুলো থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে। বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যারা পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রকৃতি ঘেরা এ দেশকে উন্নত করতে বিনোদনের জায়গাগুলো সরকারি ও বেসরকারিভাবে তদারকি করা একান্ত প্রয়োজন।    
 

টিএস

×