
যে কোনো সমাজের সমসংখ্যক নারীর উন্নয়ন কর্মযোগে যথার্থভাবে সম্পৃক্ত হওয়া অনিবার্যই শুধু নয় জরুরিও বটে। বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশের গঠন প্রক্রিয়ায় নানামাত্রিক অসাম্য বৈষম্য সামনে চলে আসছে। সেখানে সেই আদিতম ফারাক নারী পুরুষের বিভাজন। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে যে বিভাজন সমাজ সভ্যতা, সংস্কারের চিরন্তন এক ফারাক, যা আজও বহাল তবিয়তে নিত্যজীবন প্রবাহকে চালিত করছে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিত্তনির্বিত্তের দূরত্ব, আভিজাত্যের গৌরব কিংবা বংশমর্যাদার তারতম্যে মানুষে মানুষে প্রভেদ দাস সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্প প্রযুক্তির উন্নত সভ্যতায়ও যথার্থ আবেদন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিবদমান পরিস্থিতি তৈরিতে এগিয়ে থাকে। সে তো উন্নত বিশ্বের আধুনিক শিল্পায়নের নবযুগ। আর নারী-পুরুষ দুই মেরুতে দুই শ্রেণি আজও তারতম্যের শিকলে আবদ্ধ। তবে নারীরা স্নেহ কোমলই শুধু নয় মঙ্গল আর মাধুরি মেশানো। এক অপরাজেয় শক্তিমত্তায় বিশ্ব সৃষ্টিকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন সৃষ্টির রহস্য নাকি নারীর দেহ আর মনে। শুধু তাই নয় আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন- স্নেহে, মায়ায়, মমতায় নারী মাতা আর পূজায়, অর্ঘ্য,ে নিবেদনে নারী প্রিয়া। এমন চিরসত্য কবির সাহিত্যজুড়ে যত্রতত্র দৃশ্যমান। বিদ্রোহী কবি নজরুলকেও বাদ দিই কেন? বিপ্লবী মনস্তত্ত্বে যখন নজরুল আবেগে আপ্লুত হন তখন নারী ও তার কাছে নমস্য একান্ত কাছের জন। তাই আপন মনের মাধুরি মিশায়ে উদাত্ত কণ্ঠে গাইলেন-
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
নারীর সার্বিক মহিমা আর মমতাঘন আবেশ যে পরিবেশ পরিস্থিতির সুমধুর ঝংকারে সুরের মূর্ছনায় আবৃত হয় সেই নারীর চলার পথও সবসময় নিষ্কণ্টক আর অবারিত থাকে না। বিপত্তি মোটেও নয়। মাসিক ঋতুচক্রের নিয়মিত স্রাব, যা কোন নারীর মাতৃত্ব শক্তিই শুধু নয় বংশপরম্পরায় নতুন প্রজন্ম উপহার দেওয়া শুধু পরিবারই নয় দেশ ও জাতির পরম অহঙ্কারও বটে। শুধু কি মমতাঘন নারীর বন্দনা? একেবারেই না। তার চেয়ে বেশি জরুরি বিষয় পিরিয়ড বা মাসিক ঋতুস্রাবে সচেতন সাবধানতা।
এক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে উঠে আসে মাসিক ঋতুস্রাব নিয়ে অসচেতনতা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনকে পেছনে হটাতে পারে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এমন প্রবাদ বাক্য চিরন্তন আর সর্বজনীনও বটে। বয়ঃসন্ধিকালে ১৪-১৮ বছরের উদীয়মান কিশোরীরা কোন এক সময় শারীরিক কিছু বিপত্তি পার করেন। ঋতুস্রাবের প্রথম ৫ দিন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন মোটেই বিপত্তিকর নয়। বরং মাতৃত্বের অপার শক্তি জিইয়ে থাকে মাসিক ঋতুস্রাবের অন্তর্নিহিত কার্যক্রম আর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায়। প্রতি মাসের এই স্রাবের সময় সুষম ব্যবস্থাপনাও নিতান্ত জরুরি।
পুরাকালে যখন আধুনিক কোন ব্যবস্থা তৈরিই হয়নি তখন পাতলা কাপড় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ব্যবহার করাই সর্বাধিক উত্তম ছিল। স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করার সংখ্যা গ্রামনির্ভর বাংলাদেশে এখনো অপ্রতুল। আবার অপরিষ্কার ন্যাপকিন ব্যবহারে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এই সময় মাসিককে অন্যভাবে বিবেচনায় রেখে সব ধরনের ধর্মীয় কাজ থেকে বিরত রাখাও সমাজ-সংস্কারের প্রচলিত বিধি, যা আজও অক্ষুণ্ন এবং বহাল তবিয়তে টেকসইও বটে। আর গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অধিবাসী নারীরা নিজেদের অঞ্চলভিক্তিক সংস্কৃতিতে মাসিক ঋতুস্রাবকে সামলানোতে সচেষ্ট থাকে। অনেক কিশোরী এ সম্পর্কে অজ্ঞাত অবস্থায় ঋতুস্রাব প্রত্যক্ষ করে। প্রথমে বুঝতেও পারে না তার আসলে কি হয়েছে। কিংবা লাগাতর পাঁচদিন ধরে কেন রক্তস্রাব- এটা ভেবে সে ব্যাকুল হচ্ছে। পরিবারই প্রথম শিখিয়ে দেয় কিভাবে কিংবা কেন এমন হচ্ছে। মা, দাদি, বড়বোন কিংবা ভাবিরা বুঝিয়ে দেন মেয়েদের জন্য এটাই স্বাভাবিক। বরঞ্চ কোন কারণে ব্যাহত হলে চিকিৎসকের পরামর্শও জরুরি। আর মা হবার অভাবনীয় শক্তিমত্তায় এই মাসিক রক্তস্রাব যেন বিধাতারই উপহার। চিকিৎসকরা বলছেন এই মাসিক শুধু মা হবার সক্ষমতাই নয় বরং একজন কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশেও অত্যন্ত জরুরি, যার ব্যত্যয় যে কোনো নারীর জীবনকে আরও বিপন্নতায় ভোগাবে। মাসিক নিয়ে অসচেতনতার কারণে গ্রাম বাংলার সিংহভাগ কিশোরী-যুবতির হরেক মাত্রার স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থেকে যায় বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা সতর্কই শুধু নয় পরামর্শ দিতেও পিছিয়ে থাকেন না। বলা হচ্ছে মাসিক যে কোনো নারীর শরীরবৃত্তিয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তার সঙ্গে শরীরের নিঃসৃত হরমোনের সম্পর্ক রয়েছে। আবার জরায়ু ও মাসিকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাসিকের কোনো ধরনের রুদ্ধতার জাল নারীর স্বাস্থ্যের জন্য নিতান্ত বিপত্তিজনক। আর পরিবারে মাই সাধারণত তার কিশোরী কন্যাটিকে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট। কোনো চিকিৎসকের প্রয়োজনই পড়ে না। স্বাভাবিক এই রক্তস্রাব প্রক্রিয়ার। বরং উল্টোটা হলেই পরিবার চিন্তিত থাকেন তার কুমারি কন্যাটির জন্য। নারী স্বাস্থ্যের এমন প্রয়োজনীয় শক্তিমত্তাকে যথার্থ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সামলানো এক অপরিহার্য দায়বদ্ধতা। প্রথা, সংস্কার, ভ্রান্ত ও বিপরীত ধ্যান ধারণা কোনোভাবেই যেন মাসিক এই ঋতুস্রাবকে অবহেলা কিংবা উপেক্ষার বিষয় হিসেবে বিবেচনায় না আনে। তাহলে মাতৃজঠরের পরম শৌর্য বিলীন হতেও সময় নেবে না। পরিবারে মা কিংবা বড়বোন, ভাবিরা তাদের কন্যা কিংবা অনুজদের ঠিকঠাকভাবে ঋতুস্রাব বুঝার সক্ষমতায় তৈরি করে দেবেন। এটাতে কোন লোকলজ্জা নেই। বরং পরম করুণাময়ের এক অভাবনীয় আশীর্বাদের সহজাত প্রবৃত্তি।
মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের কিশোরীদের সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া চাই। মনে রাখতে হবে, সংক্রমণমুক্ত ও নিরাপদ পিরিয়ড নারীর অধিকার। তাই লজ্জা নয়, পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
প্যানেল