ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

‘চাঁদমণি’ আশ্রয়কেন্দ্র অনাথ মেয়েদের বাঁচার পথ

উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা থেকে

প্রকাশিত: ০১:০৫, ২ আগস্ট ২০২২

‘চাঁদমণি’ আশ্রয়কেন্দ্র অনাথ মেয়েদের বাঁচার পথ

আশ্রয়কেন্দ্র

উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গী গ্রামসেখানে চাওড়াডাঙ্গী স্কুল এ্যান্ড কলেজের পাশেই ছিমছাম একটি বাড়িতে অনাথ মেয়েদের আশ্রয় চাঁদমণিবাড়ির ফটকে বাঁশের সঙ্গে ঝুলানো চাঁদমণিসাইনবোর্ডপ্রধান ফটক দিয়ে সোজা তাকালে টিনশেডের আধাপাকা একাধিক ঘরসোজা ঢুকলেই লাইব্রেরি

পাঠ্য বইয়ের বাইরেও রয়েছে শিশুদের বিভিন্ন বইতার পাশে লম্বা হলরুমঘরের মধ্যে লম্বা টেবিলের দুই ধারে সারি সারি চেয়ার পেতে বসে অনাথ মেয়েরা লেখাপড়া করেফটকের ভেতরে ডান পাশের একটি ঘরে সংগ্রহশালাসেখানে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যএর ভেতরেই অনাথদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থারয়েছে শিশুদের খেলার স্থান ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনএক একর সাত শতাংশ এলাকার চাঁদমণি আশ্রমে বর্তমানে রয়েছে ৩৫ জনতারা সকলে দ্বিতীয় থেকে স্নাাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থীএ ছাড়া অনাবাসিক আরও অনেক মেয়েকে দেয়া হচ্ছে লেখাপড়ার সহযোগিতা

চাঁদমণি হলো যেভাবে

প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলমঢাকায় উত্তরা ব্যাংকের এজিএম অবস্থায় ১৯৯৬ সালে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ফিরে আসেন গ্রামেনিঃসন্তান মানুষটি পাঁচ অনাথ মেয়েকে বাড়িতে লালনপালন শুরু করেন১৯৯৯ সালে গড়ে তোলেন অনাথ মেয়ে শিশুদের আশ্রম চাঁদমণি

গত ২৩ বছরে সেখান থেকে লেখাপড়া শিখে এ পর্যন্ত বেরিয়ে গেছে অন্তত সাত শতাধিক অনাথতাদের মধ্যে অন্তত ২৫০ জন প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বিভিন্ন পেশায়নাসিংসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী চাকরিতে যুক্ত হয়েছেন অনেকে

দেড় বছর বয়সে বাবা মারা যায়বাবার কোন স্মৃতি মনে নেই রুবিনারবাবার আদর ছাড়াই মায়ের কোলে সাড়ে চার বছর বেড়ে উঠাএরপর রুবিনার ঠাঁই হয় চাঁদমণিনামক কন্যা শিশুদের অনাথ আশ্রমেসেখানেই তার হাতেখড়িরুবিনা এখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রি

সেখানে থেকে লেখাপড়া শিখে মানুষের সেবায় নার্স হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলছে ছোট্ট ওই শিশুটিনীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার কৈমারী ইউনিয়নের গাবরোল মাস্টারপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে রুবিনা আক্তারতার বাবা রফিকুল ইসলামের মৃত্যু হয় ২০০৯ সালে

দিনমজুর বাবার অকাল মৃত্যুতে তিন মেয়ে এবং সবার ছোট এক ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তার মা হাসিনা বেগমরুবিনা জানায়, বোনের মধ্যে ছোট সেমায়ের এমন অসহায়ত্বে শুধু রুবিনা নয়, ওই অনাথ আশ্রমে ঠাঁই হয়েছে তার দুই বড় বোনেরও

তাদের মধ্যে সবার বড় রুমি আক্তার লেখাপড়া করেছে ১০ম শ্রেণী পর্যন্তএরপর বিয়ে হয়েছে চার বছর আগেমেজো বোন রোজিনা আক্তার এবার ১০ম শ্রেণীর ছাত্রিবর্তমানে সেখানে মেজবোন রোজিনা আক্তারের সঙ্গে তার বেড়ে উঠালেখাপড়ার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখা সবই রয়েছে অটুটরোজিনাও লেখাপড়ায় এগিয়ে চলছে সাংবাদিক হওয়ার ব্রতে

এমন পেশায় যুক্ত হয়ে দূর করতে চান সমাজের সকল অসঙ্গতিতাদের পরিবারের সবার ছোট ভাই রাকিবুল ইসলাম রকি মায়ের কাছে থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে গ্রামের বিদ্যালয়েআর তাদের মা জীবিকা নির্বাহ করছেন ক্ষেত-খামারসহ বিভিন্ন বাসাবাড়ির কাজের কায়িক শ্রমের আয়ে

চাঁদমণি মেলা

অনাথ মেয়েদের আশ্রয় ভাবনা নিয়েই থেমে নেই চাঁদমণিএলাকায় ঘটাতে চায় সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশউদ্ধার করতে চায় গ্রামীণ হারানো ঐতিহ্যবিকশিত করতে চায় গ্রামীণ কুটির শিল্পেরএমন উদ্দেশ্য নিয়ে দুই বছর পর করে গ্রামীণ মেলার আয়োজনসে মেলার পরিচিতি এখন চাঁদমণি মেলানামেচাঁমণির মেয়েরা স্টল সাজিয়ে তাদের তৈরি বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন করেঅংশ নেয় বাইরের মেয়েরাও

সুশৃঙ্খল মেয়েদের পরিচালিত এসব দোকানে ক্রেতার কমতি থাকে নাগ্রামীণ নারী জাগরণে এমন মেলার গুরুত্ব রয়েছেমেলা পরিচালনায় মেয়েরা যেমন মেধা এবং মমনশীলতা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনি বিকাশ ঘটছে নেতৃত্বের

যা বলছেন অনাথদের অভিভাবকরা

জেলার জলঢাকা উপজেলার কৈমারী ইউনিয়নের গাবরোল গ্রামের হাসিনা বেগম২০০৯ সালে দিনমজুর স্বামী রফিকুল ইসলামের মৃত্যু হলে তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েনতার এমন দুর্দিনে আশার আলো জাগায় চাঁদমণিতিনি বলেন, ‘পাঁচ বছরের রুমি, আড়াই বছরের রোজিনা, দেড় বছরের রুবিনা এবং ছয় মাসের গর্ভে থাকা ছেলে রাকিবুলকে রেখে তাদের বাবা মারা যায়

এরপর প্রতিবেশী ডিম বিক্রেতা প্রদীপ চন্দ্র রায়ের কাছ থেকে ওই আশ্রমের সন্ধান পাইনিরুপায় হয়ে সেখানে গিয়ে তিন শিশু মেয়েকে রেখে আসিএরপর বড় মেয়ে রুমি ১০ম শ্রেণীতে পড়ার পর বিয়ে দিয়েছি চার বছর আগেএখনও দুই মেয়েকে সেখানে থেকে লেখাপড়া করছে

তিনি বলেন, ‘পিজিরুল আলম একজন দানশীল মানুষতিনি না থাকলে হয়তো আমি ওই সুযোগ পেতাম নাবেশিদিন বেঁচে থাক এই মানুষটামনার মা অজিফা বেগম বলেন, ‘হামেরা গরিব মানষিছাওয়ালার (সন্তান) বাবার মৃতুর পর খুব কষ্ট ছিল সংসারোতবাধ্য হয়া দুইটা ছাওয়াক চাঁদমণিত পাঠাইনুএলা ছাওলা মানুষ হইছেমোর ছাওয়ালার মতন আরও মেল্লা ছাওয়া ওইছে মানুষ হছেআল্লাহ করি পিজিরুল ভাইর ভাল হইবে

তিনি জানান, সেখানে নিজের বাড়ির মতো মেয়েরা থেকে লেখাপড়া করছেথাকা খাওয়াসহ লেখাপড়া সেখান থেকে দেয়া হয়অনেক মেয়ে লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন স্থানে চাকরিসহ নানা পেশায় নিযুক্ত হয়েছেএটি না হলে অনেক মেয়ের ভাগ্যে হয়তো লেখাপড়া জুটত না

×