
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ খুব প্রয়োজন। আকাশ আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে তারা হবে উদার। কিন্তু যেভাবে নগরায়ণ হচ্ছে, তাতে খেলার মাঠগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সময়ে বিশাল বিশাল খেলার মাঠ ছিল। নিত্যদিনের প্রয়োজনের সঙ্গে বিকেলে খেলতে যাওয়াটাও রুটিন ছিল। স্কুল ছুটি থাকলে আমাদের মাঠে যাওয়ার কোন নির্দিষ্ট সময় থাকত না। বন্ধুরা মিলে খেলতাম দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, কাবাডি, সাতচারা, মাংস চোর, কানামাছি- কত রকম খেলা! এখনকার শিশুরা এসব খেলার নামই জানে না। জানবেই বা কি করে! ওদের তো আর আমাদের মতো মাঠ নেই, তাই খেলার সুযোগও নেই। তাই এলাকায় ওদের বন্ধু-বান্ধবও কম। মাঠে যেতে না পারায় ওদের জীবন হয়ে গেছে ইন্টারনেটনির্ভর। সারাদিন মোবাইলে গেমস আর টিভিতে কার্টুন দেখেই কাটে ওদের সময়। এভাবে তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ওদের মধ্যে সামাজিকীকরণও হচ্ছে না বললেই চলে। কোথাও বেড়াতে গেলেও তারা ট্যাব, মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এতে তাদের চোখে উঠছে ভারি চশমা। সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তিও লোপ পাচ্ছে। বন্ধুত্বের মাঝে সবাই সবার ভাবনাগুলো শেয়ার করলে সবার মাঝেই সৃষ্টিশীল কিছু করার ইচ্ছে জাগে। খেলার মাঠের অপ্রতুলতার কারণে তারা ঘরকুনোও হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর ব্রিজ হওয়ার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। আর বিলীন হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। প্রজেক্ট এলাকাগুলোতে বাচ্চারা একটু খেলার সুযোগ পায়, তাও রাস্তায়। কিন্তু একটু পরপর রিকশা গাড়ি চলে আসায় বার বার খেলা গুটিয়ে নিতে হয়। সেখানেও শিশুদের জন্য খেলার মাঠ কেউ দিচ্ছে না। প্রতিটা প্রজেক্টেই বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠ রাখা উচিত। যেহেতু এটা পরিকল্পিত এলাকা। খোলা জায়গাগুলোতে দালান-কোঠা হওয়ার জন্য বাচ্চাদের খেলার জায়গা আরও নাই হয়ে যাচ্ছে। নয়াটোলা শিশুদের জন্য ছোট্ট একটা পার্ক ছিল। বিকেলে বাচ্চারা খেলাধুলা করত। সেটাও এক অংশ সিটি কর্পোরেশন দখল করেছে ময়লা রাখার ঘর করে। আরেক অংশে ক্লাব ঘর। সেখানে বড়দের খেলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে বাচ্চাদের খেলার জায়গাটা ছোট্ট হয়ে গেছে। মাঠে গেলে অনেক শিশুর সঙ্গে মেলামেশা আর পারস্পরিক কথোপকথনের ফলে তাদের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে, নতুন অনেক কিছু জানতে পারে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতেও শিখে। ঈদের আগে কলাবাগান তেঁতুলতলার ছোট্ট মাঠটি প্রায় দখলই হয়ে গিয়েছিল। তা বাঁচাতে ৬-১২ বছর বয়সী ৩০/৩৫ জন শিশু, সমাজের কিছু বিশিষ্টজন আর কিছু সংগঠনের সম্মিলিত প্রতিবাদে আর সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মাঠটি রক্ষা পায়। বাচ্চাদের কি আকুতি, ‘মাঠ না থাকলে আমরা খেলব কোথায়! সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকব, গেমস খেলব, কার্টুন দেখব।’ কতটা আকুল হয়ে তারা কথাগুলো বলছিল। এই এক চিলতে মাঠ, তারা এখানে খেলাধুলা করে। এটাও না থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে আর ক্রিকেট খেলাও হবে না। সব মাঠের জন্য তো আর এমন প্রতিবাদ হয় না। তাই এভাবেই মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা এলাকায় ছোট হলেও একটা মাঠ দরকার শিশুদের শারীরিক আর মানসিক বিকাশের জন্য। তবেই বিকশিত হবে আগামী প্রজন্ম।
ব্রিটিশ গায়ক ক্যাট স্টেভেন্স (পরিবর্তিত নাম ইউসুফ ইসলাম) তার বেড়ে উঠার সময় দেখলেন, বেপরোয়া নগরায়ণের জন্য কংক্রিটের আবরণে তৈরি সু-উচ্চ দালান ঢেকে দিচ্ছে শহরের সবুজ। দখল করে নিচ্ছে আকাশ। এসবের প্রতিবাদে তিনি গাইলেন-
‘আকাশ চিরে দালান উঠছে,
বাতাসকে সরিয়ে ইমারত।
সবুজ ঘাসকে সরিয়ে রাস্তা গড়েছ
কংক্রিটে ঢেকেছ খেলার মাঠ।
জানি, বহু পথ পেরিয়ে তোমরা নগর গড়েছ
বলতে পারো, ছেলেমেয়েরা খেলবে কোথায়?’