
করোনাভাইরাসের কারণে মননকে অনলাইনে ক্লাস করতে হয়েছে। গৃহশিক্ষক রানাকে বাসায় আসতে হয়নি। তিনি অনেক দিন পর আজ বাসায় এসেছেন। স্যারকে কাছে পেয়ে সেলফি তুলে মনন ফেসবুকে পোস্ট দিল। ক্যাপশন লিখল, অনেক দিন পর প্রিয় রানা স্যারের সঙ্গে আজ পড়ার টেবিলে। স্যার বুঝতে পারলেন মননের মানসিক অবস্থার অনেক পরির্বতন হয়েছে। রানা স্যার বললেন, ‘কেমন আছ?’
‘স্যার, করোনার জন্য কেউ ভাল নেই। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আমার পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে। তাই আমিও ভাল নেই।’
‘তা ঠিক বলেছ। এখন থেকে মোবাইল ফোনে আর খেলাধুলা করা যাবে না। নিয়মিত পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে হবে।’
‘ঠিক আছে স্যার। আপনি এখন নিয়মিত আসবেন। পড়ালেখা নিয়মিত করব।’
‘ভেরি গুড। এখন পড়া শুরু করা যাক।’
‘স্যার পড়া শুরু করার আগে একটা কথা বলতে চাই।’
‘কি কথা বলো।’
‘স্যার, আপনার হাতের বইটা দেখছি, ‘নৈতিকতা ও রাজনীতিতে মানবসমাজ’ লেখকের নাম বার্ট্রান্ড রাসেল। এই রাসেলের নাম দেখে আমরা বন্ধু রাসেলের কথা মনে পড়ল।’
‘লকডাউনে প্রচুর বই পড়েছি। এটার পড়ার একটু বাকি আছে। গাড়িতে পড়তে পড়তে আসছিলাম। আর হ্যাঁ, তোমার বন্ধু রাসেল। কোন রাসেল। আমি কি তাকে চিনি। তার পুরো নাম কি?’
‘চেনেন স্যার। সবাই চেনে তাকে। তার জন্য অনেক কষ্ট হয়। তার পুরো নাম শেখ রাসেল।’
‘ও, আচ্ছা। শেখ রাসেল! তোমার বন্ধু হয় কি করে?’
‘স্যার, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তেন। আমি এখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। রাসেলের ছবি দেখলেই তাকে বন্ধু বলে মনে হয় আমার। শুধু আমি না আমার মতো অনেকেই রাসেলকে বন্ধু ভাবে।’
মননের কথা শুনে স্যার সত্যি অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিক কথাই বলেছ। তবে কি জানো।’
‘কি স্যার।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন শেখ রাসেল।’
‘ধন্যবাদ স্যার। তথ্যটা জানানোর জন্য। স্যার রাসেলের পড়ালেখা নিয়ে কোন ঘটনা আপনার জানা আছে। আমার না তার পড়ালেখা বিষয়ে খুব জানার ইচ্ছা।’
‘কত ঘটনা জানি। তবে সব জানি না। কিছু ঘটনা জানি।’
‘স্যার, তাহলে একটু বলেন।’
‘তাহলে শোনো। রাসেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন গীতালি চক্রবর্তী। তার সাথে কিছু মজার স্মৃতি আছে। গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন। সেখান থেকে আমি জানতে পেরেছি। তোমাকে বলছি- রাসেল অঙ্ক করতে অপছন্দ করতেন। একদিন তার গৃহশিক্ষক গীতালি তাকে পাঁচটি অঙ্ক করতে দেন। অঙ্কগুলো করেছিলেন। তখন আরও একটা অঙ্ক দেন। তখন রাসেলে ক্ষেপে গিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান। একটু পরে তার মাকে সঙ্গে করে পড়ার ঘরে নিয়ে আসেন। ঘরে ঢুকেই রাসেলের মা খুব রাগের সুরে গীতালিকে বললেন, কি রে তুই না-কি রাসেলকে পাঁচটা অঙ্ক করার কথা বলে ছয়টা অঙ্ক দিছিস? বলেই একটা চোখ টিপ দিয়েছিলেন রাসেলের মা। যাতে গীতালি রাগ না করেন। এরপর বললেন, এ রকম আর করবি না কখনও।’
‘স্যার, আমিও তো অঙ্ক করতে কম পছন্দ করি না।’
‘তা তো জানি।’
মননের মা পড়ার টেবিলে নাশতা দিয়ে গেলেন। ফল আর রুটি আর মিষ্টি দেখে রাসেলের কথা মনে পড়ল। বললেন, ‘মনন, এই যে মিষ্টি দেখছ। এই মিষ্টি নিয়ে মজার ঘটনা আছে।’
‘বলেন স্যার।’
‘রাসেলের গৃহশিক্ষক গীতালি মিষ্টি খেতে পছন্দ করতে না। কখনও খেতেন কখন বা একটা মিষ্টি খেতেন। একদিন হঠাৎ পড়তে পড়তে রাসেল জিজ্ঞেস করলেন, আপা, আপনি এক দিনও মিষ্টি খান না কেন? গীতালি বলেন, ক্যানো, খাইতো। জবাবে রাসেল বলেন, মাঝে মাঝে খান। রোজ মিষ্টি খান না কেন? আমি মিষ্টি পছন্দ করি না যে, তাই খাই না। রাসেলেরও তাৎক্ষণিক জবাব, আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না, তবে, আমারে রোজ রোজ পড়ান ক্যান? পরে সেদিন গীতালি বাধ্য হয়ে দুটো মিষ্টি খেয়েছিলেন।’
স্যারের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে লাগল মনন। এমন সময় বলল, ‘স্যার রাসেল পড়া না পাড়লে তার গৃহশিক্ষক কি শাস্তি দিতেন?’
‘অবশ্যই দিতেন। কানমলা দিতেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের রাতেও অঙ্ক ভুল করে রাসেল।’
মনন বলল, ‘স্যার ওই রাতেই তাহলে রাসেলের শেষ পড়া হয়।’
‘হ্যাঁ, এদিন, বিকালে রাসেল বাড়িতে ছিল না। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন। গীতালি একা একা অপেক্ষা করছিলেন। একটা সময় চলে যাওয়ার কথাও ভাবেন। এমন সময় বঙ্গবন্ধু উপরে এসে স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে বলে উঠেন, মাস্টার তুই একা কেন। ছাত্র কোথায়? বঙ্গবন্ধু গীতালিকে মাস্টার বলে ডাকতেন। রাসেল বাড়িতে নেই শুনে তিনি গীতালিকে নিচে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি আছে, তাতে করে চলে যাওয়ার কথা বলেন। তখন রমা বলে রাসেল আপুকে থাকতে বলেছেন। এসে পড়বে। বঙ্গবন্ধু তখন ফোন করে জেনে নেন এবং গীতালিকে আবার উচ্চস্বরে বলেন, মাস্টার তোমার ছুটি নাই। তোমার ছাত্র আসতেছে। রাসেল এসে পড়তে বসলেন। অংক ভুল করলেন। এ জন্য কানমলা না কান ধরে ওঠবস করতে হবে জানতে চায় রাসেল। গীতালি বলেন, তিনিই কানমলা দেবেন। রাসেল তখন হাসতে হাসতে বলে, আপনার কান মলাতো পিপড়ার কামড়ের মত। কোন ব্যথাই পাওয়া যায় না। এদিন তিনি মোট দুটো কানমলা দিয়েছিলেন রাসেলকে। রাত সাড়ে ১১টায় গীতালি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বের হন।’ এই বলেই স্যারের মন খারাপ হয়ে গেল। স্যারের মন খারাপ বুঝতে পেরে মনন আর কোন প্রশ্ন করল না। মনন ভাবল, রাসেল আজীবন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার