
বাঙালীর আটপৌরে দৈনন্দিন জীবনে রয়েছে নানা রং ও রূপ। গ্রামীণ জীবন এবং নগর জীবনেরও রয়েছে দ্বৈত ব্যবহারিক বিধি। আর রয়েছে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টিও। বিশেষ করে অনাদিকাল ধরে বাংলার ‘নারীর প্রথম ব্যবহারিক উপকরণ হলো শাড়ি। নানা রকম বৈচিত্র্যময় শাড়ি নিয়ে লিখেছেন- রেজা ফারুক
শাড়ি নারীর প্রধান পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে পছন্দের শীর্ষ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে কবে সেই সময় নিরুপন করা সহজসাধ্য নয়। মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ তার শারীরিক আচরণ হিসেবে বস্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে আসছেন। সেই ইতিহাসের পথ বেয়ে মধ্য যুগে উপনীত হওয়া সামাজিক জীবনচারে বস্ত্র পরিধান আরও অধিক মাত্রার প্রাধান্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি বস্ত্র ব্যবহারে বৈচিত্র্যের খোঁজে মানুষ এ উপকরণটাকে আরও দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপনের মনোনিবেশ করে। তারপর সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে। মধ্যযুগের পর প্রবেশ ঘটে আধুনিক যুগের। বস্তুত পক্ষে এই আধুনিক বা বিজ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে যুগের মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে। এই রূপ বদলের পূর্বের ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ। আরও নান্দনিক। যে নান্দনিকতার ফিতর দিয়ে বাঙালির আদিও ও অকৃত্রিম চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চিত্রটিই নিবিড়ভাবে ফুটে ওঠে।
আধুনিক যুগের মানুষেরা পূর্বেকার সময়ের ক্যানভাসে চোখ রাখলে ভেসে উঠবে ঐতিহ্যের এক অবিস্মরণীয় চিত্রকলা। যে চিত্রের ফ্রেম বন্দী হয়ে আছে আবহমান বাংলার চিরন্তন রূপঐশ্বর্য্যরে অনুপম দৃষ্টিনন্দন বস্ত্রাবরণ মুসলিম আর জামদানি শাড়ির শৈল্পিক উপখ্যান। যে উপখ্যানের পরতে পরতে অঙ্কিত হয়ে আছে শিল্পীর হাতে বোনা নরম আঙ্গুর্লের শিশির স্নাত স্পর্শ আর শিল্পের উৎকর্ষ অবগাহন। যেনো কাব্যিক মুর্ছনার ছড়া কেটে কেটে সিম্ফনির আকণ্ঠ শিল্পবোধের ফিতর দিয়ে নিবিড় পরিচর্যা অতিসূক্ষè সুতা তন্ত্রর বুননে জগত বিখ্যাত এক একটি মুসলিম আর জামদানি শাড়ি মুসলিম আর জামদানি শাড়ির কারিগরের হাত হয়ে তা পৌঁছে যেতো ব্যবহারকারীর হাতে। তার এ অতুলনীয় আর অনুপমসৌন্দর্যমন্ডিত মূল্যবান শাড়ি তৎকালীন ভারতবর্ষের রান সম্রাজ্ঞী, বাদশাহজাগী কিংবা তৎকালীন সৌখিন উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের পরার সৌভাগ্য হতো। বিশেষ করে মসলিন শাড়ির কথা যদি বলি-তাহলে বলা যায় যে এ শাড়িটি এতোটাই সূক্ষè্র তন্তদ্বার দিয়ে তৈরি হতো। যা দেখে যে কোনো রুচিশীল রমনীরই চোখ হয়ে উঠতো আনন্দোজ্জ্বল। এ শাড়ি বুননের কলাকৌশল বানতেন খুবই কম শিল্পী। মসলিন শাড়িরও কারিগরদের কাছে নক্সা প্রদর্শন করে তৎকালীন রাজা বাদশাহরা তাদের স্ত্রী, কন্যা ও পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের জন্য অর্ডার করে বানিয়ে নিতেন। মসলিনের পাশাপাশি জামদানি শাড়িরও ছিলো একই আবেদন। যা এখনও অটুট রয়েছে। তবে, জামদানি শাড়ি যেহেতু সুতির তন্ততে বুনন হতো (রেশমি সুতোয়ও) তাই মসলিন অপেক্ষা জামদানির আবেদন ছিল কিছৃুটা কম। তাঁতশিল্পেরাও মসলিন এবং জামদানি। যেনো এক অনির্বচনীয় গল্পকথার নাম। দেনা এক প্রাতঃস্মরণীয় কিংবদন্তির জায়গায় অবস্থান করছে এ দুটি শাড়ির শিরোনাম। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া বাংলাদেশের এ দু’টো শাড়ির সুখ্যাতি এই কর্পোরেট যুগেও কদরের দিক থেকে উৎকৃষ্ট স্থানে অবস্থান করছে। সবচেয়ে আনন্দের কথা হলো জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ গত বছর মসলিন ও জামদানি শাড়িকে বাংলার হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এই শাড়ি প্রস্তুতকারী শিল্পীদের মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মসলিন এবং জামদানী এ দুটো শাড়ির প্রস্তুতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অলৌকিক প্রসঙ্গ। যা সত্যিই অবাক করা বিষয়। সেই আদি যুগ থেকে এখন পর্যন্ত এ শাড়ি প্রস্তুতের জন্যে যে আবহাওয়া প্রয়োজন। সেটি রয়েছে’ একমাত্র নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও আড়াই হাজার থানা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে। এক সময় এ জামদানি শিল্পের বিপুল সম্প্রসার থাকলেও অসহনীয় দামের কারণে ক্রমশ: এ শিল্পটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যার দরুণ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে পড়েছে অপরিহার্য। মসলিন আজ এক বিলুপ্ত শাড়ি। শিল্পের নাম। এ’ শাড়িটি কেবল সোনারগাঁতেই তৈরি হতো। সেও প্রায় কয়েক শতক আগে। ব্রিটিশ রাজপরিবারে বর্তমানে দু’একটি মসলিন শাড়ি অক্ষত থাকার কথা জানা গেছে।
ঢাকাই জামদানি নামে খ্যাত-জামদানি শাড়ি বর্তমানে কোনরকম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও মসলিন যুগ ফিরছে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ঢাকাই জামদানির মতো আরও কতিপয় শাড়ি বর্তমানে বাংলার নারীদের কাছে খুবই প্রিয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো টাঙ্গাইল শাড়ি। নান্দনিক ডিজাইনের এ শাড়িটি বর্তমানে বাংলার প্রতিটি উৎসবে এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সহনীয় দামের টাঙ্গাইল শাড়ির কদর মধ্যবিত্ত বাঙালী শহুরে রমণীদের কাছে যেমন প্রিয়। তেমনি গ্রামীণ নারীরাও এ শাড়িটি নিয়মিতই পরিধান করেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। শাড়িতেই যে নারীর অপরূপ সৌন্দর্য নান্দনিক রূপে ফুটে ওঠে সে গল্প কবিতা, গান, শিল্প, সাহিত্য ও ঐতিহ্যে দৃশ্যমান। তাই বলা যায় সব পোশাককে ছাড়িয়ে কালের ধারায় শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে শাড়ি যা বাংলার নন্দিত শিল্প হিসেবে যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত হয়ে আসছে।