ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

একটি চমৎকার ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের বাস্তবায়ন

জোনায়েদ হোসেন

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ২০ জানুয়ারি ২০২৩

একটি চমৎকার ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের বাস্তবায়ন

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলাম

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তৃতীয় বর্ষ থেকে চাকরির চিন্তাটা ভালোভাবে আমার মাথায় আসে। তখন আমার লক্ষ্য ছিল না বিসিএস ক্যাডার হওয়া  (আসলে বিসিএস সম্পর্কে তেমন জানতাম না)। মানুষ বলত পাওয়ারফুল লবিং ছাড়া ক্যাডার হওয়া যায় না। আমিও তা বিশ্বাস করেছিলাম। সে জন্য প্রাইভেট কোনো চাকরি বা ব্যাংকই ছিল আমার টার্গেট। প্রাইভেট চাকরির কথা চিন্তা করে আইবিএ থেকে এমবিএ বা সিএ করব কিনা ভাবছিলাম।

চট্টগ্রাম থেকে একবার কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এসে আইবিএ (ঢাবি) এবং সিএ ভবন ঘুরে গেলাম। সিএ একটা দীর্ঘ মেয়াদি কোর্স, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আইবিএর জন্য ট্রাই করব। অনেকগুলো বই কিনে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলোও পড়ছিলাম। আমি ইংলিশ মিডিয়ামের  (ও লেভেল এবং এ লেভেল) ছাত্রদের গণিত পড়াতাম। তাই গণিত নিয়ে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইংরেজিতে দুর্বলতা ছিল। তাই একটা কোচিং সেন্টারে স্পোকেন ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম এবং বেশ গুরুত্ব দিয়ে সব ক্লাসে এটেন্ড করলাম।

ভালোই উন্নতি করলাম। কর্মক্ষেত্রে ও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটারের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ভাবলাম কম্পিউটারের ওপর একটা ট্রেনিং করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে আইসিটি সেন্টারে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলাম। বেশ গুরুত্ব দিয়ে ট্রেনিং করলাম এবং প্রথম হলাম। এর পাশাপাশি পত্রিকা, প্রচুর বই পড়া ছিল আমার রুটিন মাফিক কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটিতে এক মাসের একটা ডিবেট কর্মশালায় অংশগ্রহণ করলাম (যা পরবর্তীতে খুব কাজে লেগেছে)।

ফোর্থ ইয়ারে উঠে ভাবতে লাগলাম- কী করব? এর মধ্যে ৩৪-তম বিসিএস এবং সোনালী ব্যাংকের একটা বড় সার্কুলার হলো। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার ডেটও দিল। অ্যাপিয়ার সার্টিফিকেট দিয়ে দুটোতেই আবেদন করলাম। সবকিছু সমন্বয় করে পড়ছিলাম। ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল শেষ করার পরই ৩৪-তম বিসিএস এর প্রিলিমিনিয়ারি দিলাম। ৩৪-তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারির ফলাফল দুবার দেয়া হয় (প্রথমে ১২ হাজার, পরে একটা আন্দোলনের পর ৪৬ হাজার)। আমি প্রথম তালিকাতেই ছিলাম। খুব ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করলাম।

মাস্টার্স আর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি একসঙ্গে নিতাম। এরপর ৩৪-তম বিসিএস এর লিখিত আর মাস্টার্স (ফাইনাল) পরীক্ষা একসঙ্গেই হয়, মাস্টার্সে সপ্তম হই। এরই মধ্যে সোনালী ব্যাংক ও ৩৪-তম বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ভাইভা দিলাম। বেকার জীবন শুরু (ছয় মাস)! কী করব ভাবছিলাম। শিক্ষক নিবন্ধন (কলেজ) এর পরীক্ষা দিলাম এবং পাস করলাম। আইডিবির একটা আইটি ট্রেনিং (এক বছর মেয়াদি, ঢাকায়) বৃত্তির জন্য অ্যাপ্লাই করে পরীক্ষা দিয়ে পাসও করলাম। কিন্তু সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে বলে আর ভর্তি হইনি।

 
চট্টগ্রাম থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় এসে বিভিন্ন জায়গায় এপ্লাই করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারি পরিচারক পদে লিখিত পরীক্ষা দিতে গিয়ে বুঝলাম রাইটিং এ আরও ভালো করতে হবে। একটা কোচিংয়ে রাইটিংয়ের জন্য তিন মাসের কোর্সে ভর্তি হলাম। আমার বিশ্বাস এটি আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এই সময়টা আর্থিক ও মানসিকভাবে খুব কষ্টের ছিল। ২০১৫ সালের জুনে সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে চাকরিটা পেয়েই গেলাম।

প্রথম অ্যাপ্লাই, প্রথম ভাইভা! ৩৪-তম বিসিএস এর রেজাল্ট দিল, ৩৫-তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার দুইদিন আগে। ৩৪-তম বিসিএস এ চূড়ান্তভাবে নন ক্যাডারে বিবেচিত হই। ফলে মন খারাপ নিয়ে ৩৫-তম বিসিএস দিলাম। ইতোমধ্যে ৩৪-তম বিসিএস এ নন-ক্যাডারে (প্রথম শ্রেণি) শিল্প মন্ত্রণালয়ের গবেষণা কর্মকর্তা পদে চাকরি পেলাম। কিন্তু যোগদান করিনি। ৩৫-তমের ভাইভা খারাপ দিলেও তথ্য ক্যাডারে মেধা তালিকায় প্রথম হলাম। সোনালী ব্যাংক ছেড়ে তথ্য ক্যাডারে জয়েন করলাম। জয়েন করে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। ক্যাডারগুলোর মধ্যে অনেক বৈষম্য! মেরিট লিস্টে আমার অনেক পেছনের কেউ অন্য ক্যাডারে আমার চেয়ে সুবিধা বেশি পাবেÑ এটা মানতে পারিনি! ৩৬-তম বিসিএস এ ভাইভা দিতে গেলে ভাইভা নিলই না। বলল, ‘ক্যাডার তো আছোই।’ মনে কষ্ট নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। কিন্তু রেজাল্ট দিলে দেখি ট্যাক্স ক্যাডারে আমি মেধা তালিকায় তৃতীয়! এখন আমি সহকারী কর কমিশনার হিসেবে এখানে কর্মরত আছি। পররাষ্ট্র ক্যাডারের জন্য আলাদা আকর্ষণ থাকায় ৩৭-তম বিসিএসও দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম। এ ছাড়া আমি বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রাইভেট ব্যাংক ও আরও অনেক জায়গায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছিলাম। ভাইভা দিইনি। এই যে আমার ক্যারিয়ার প্ল্যান ও পরিশ্রম তা কিন্তু আমাকে ফল দিয়েছে। আমি গতানুগতিক কোনো কোচিং করিনি। নিজে বুদ্ধি করে গুছিয়ে অনেক বই পড়েছি। বুঝে শুনে পড়েছি যাতে প্রকৃত শেখা হয়। আমার জীবনের গল্প যদি একজনের জীবনেও কাজে লাগে আমি খুশি হব। জীবন একটাই, সাজিয়ে নিন। সবার জন্য শুভ কামনা রইল।
লেখক : সহকারী কর কমিশনার
৩৬-তম বিসিএস

×