ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

দুর্ঘটনার আগেই ঝুঁকি নিয়ে উড়ছিলেন পাইলটরা—নাইটভিশনের আড়ালে থাকা ভয়াবহ ভুল

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ২ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ১৫:৫৩, ২ আগস্ট ২০২৫

দুর্ঘটনার আগেই ঝুঁকি নিয়ে উড়ছিলেন পাইলটরা—নাইটভিশনের আড়ালে থাকা ভয়াবহ ভুল

ছবি: সংগৃহীত

ওয়াশিংটনের আকাশে জানুয়ারিতে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনায় একটি মার্কিন সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার একটি যাত্রীবাহী বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে। সেই দুর্ঘটনার তদন্তে বিশেষজ্ঞরা শুক্রবার জানালেন, হেলিকপ্টার পাইলটরা যেসব নাইটভিশন চশমা পরে ছিলেন, তা বিমানের অবস্থান চিহ্নিত করতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নাইটভিশন গগলস বিমানের রঙিন আলোগুলো ঠিকঠাক দেখতে দেয় না, যা দেখে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারটি বিমানের দিক নির্ধারণ করতে পারত। একইসঙ্গে, এই গগলস পাইলটদের পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিশক্তিও অনেক কমিয়ে দেয়—যা রোনাল্ড রিগ্যান ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের মতো ব্যস্ত এলাকায় উড়ার সময় ঝুঁকিপূর্ণ।

মারাত্মক এই সংঘর্ষে উভয় উড়োজাহাজের সব ৬৭ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার তদন্তে এনটিএসবি আয়োজিত তিন দিনের সর্বশেষ প্রকাশ্য শুনানিতে নাইটভিশন ব্যবহারের বিষয়টি উঠে আসে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সেদিন রাতে আরও একটি বড় সমস্যা ছিল—বিমানের আলো ও স্থলভাগের আলোর পার্থক্য বোঝা। সেইসঙ্গে, যাত্রীবাহী বিমানটি একটি কম ব্যবহৃত রানওয়েতে নামছিল, যা হেলিকপ্টার পাইলটদের জন্য আরও বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।

মানব-কারণ বিশ্লেষক এবং নাসার সাবেক কর্মী স্টিফেন ক্যাসনার বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—কোথায় তাকাতে হবে সেটা জানার বিষয়টি।”

এর আগের দুই দিনের শুনানিতে দুর্ঘটনার নেপথ্যের একাধিক কারণ উঠে আসে, যার প্রেক্ষিতে বোর্ড চেয়ারপার্সন জেনিফার হোমেন্ডি ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে (এফএএ) সতর্ক করে বলেন, “আরও ভালো করতে হবে।” কারণ, আগে থেকেই দেওয়া অনেক সতর্কবার্তা এফএএ অগ্রাহ্য করেছে।

যেসব বড় সমস্যাগুলো উঠে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে—ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক ওপরে উড়ছিল। এছাড়া, বহু বছর ধরেই যে এলাকা দিয়ে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার চলাচল করে, সে বিষয়ে সম্ভাব্য বিপদের ব্যাপারে এফএএ কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছিল।

তবে এনটিএসবি এখনো চূড়ান্তভাবে দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণ করেনি। বোর্ডের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসবে আগামী বছর।

তবে এই সপ্তাহের শুনানিতে স্পষ্ট হয়েছে, যেদিন ভয়াবহ এ সংঘর্ষ ঘটে, সেদিন ব্ল্যাক হক যে রুটে উড়ছিল, সেটি ছিল বিপজ্জনকভাবে সংকীর্ণ—যেখানে সামান্যতম ভুলও মারাত্মক হতে পারত।

মার্কিন সেনাবাহিনীর কর্নেল অ্যান্ড্রু ডিফরেস্ট জানান, “ওয়াশিংটনের হেলিকপ্টার রুট সাধারণত নিরাপদ বিবেচনা করা হয়।” তবে তিনি বলেন, সেই রাতে উড়ন্ত ইউনিটের পাইলটরা আগেই এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিলেন—এই জটিল আকাশপথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই।

যাত্রীবাহী আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমানটি উইচিটা, কানসাস থেকে আসছিল। বিমানে ছিলেন—একদল তরুণ ফিগার স্কেটার, তাদের অভিভাবক ও কোচ, এবং চারজন স্থানীয় নির্মাণ শ্রমিক।

এই সংঘর্ষ ছিল ২০০১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা। আর ২০২৫ সালে এটি ছিল একাধিক দুর্ঘটনা ও ঘনঘন ঘটতে থাকা সংকটের মধ্যে প্রথম বড় ঘটনা।

শুক্রবারের শুনানিতে এনটিএসবি কর্মকর্তারা এফএএ-কে একহাত নেন। তারা অভিযোগ করেন, জনসম্মুখে নিরাপত্তা নিয়ে যত বড় বড় কথা বলছে এফএএ, বাস্তবে তদন্তে সহযোগিতা করছে না।

বোর্ড সদস্য টড ইনম্যান বলেন, “যা বলা হচ্ছে আর বাস্তবে যা ঘটছে, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।”

এফএএ-এর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল শাখার প্রধান ফ্রাঙ্ক ম্যাকইনটোশ বলেন, তিনি তদন্তে পুরোপুরি সহযোগিতার জন্য কাজ শুরু করবেন। পাশাপাশি স্বীকার করেন, রিগ্যান টাওয়ারের সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা মেনে চলার বিষয়ে এখনো ঘাটতি রয়েছে।

“আমরা কিছু জিনিস হয়তো মিস করেছি—ইচ্ছাকৃত নয়। অনেক সময় কিছু কেন্দ্র সঠিক পথ থেকে সরে যায়,” বলেন তিনি।

হোমেন্ডি বলেন, “শুধু ওপর থেকে নিরাপত্তার নির্দেশ পাঠালেই হবে না—ক্ষেত্রে থাকা নিয়ন্ত্রকদের কথাও শুনতে হবে।”

এই দুর্ঘটনায় নিহত বিমানের সহ-পাইলট স্যাম লিলির বাবা, অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ টিম লিলি বলেন, তিনি আশা করছেন এই দুর্ঘটনার পর অন্তত কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

তবে তিনি বলেন, “আমরা এখনো অনেক পেছনে।”

বিশেষভাবে তিনি ক্ষুব্ধ হন এই কারণে যে, দুর্ঘটনার পরও নিয়ন্ত্রকদের কোনো ধরনের অ্যালকোহল পরীক্ষা করা হয়নি।

“তারা নানা অজুহাত দিয়েছে—কোনোটাই গ্রহণযোগ্য ছিল না,” বলেন লিলি। “এটা আসলে পুরো এক ব্যবস্থার ব্যর্থতা, যেখানে নিয়ম ভেঙে ফেলা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

হোমেন্ডি বৃহস্পতিবার জানান, দুর্ঘটনার দুই ঘণ্টার মধ্যে অ্যালকোহল পরীক্ষা সবচেয়ে কার্যকর, আর আট ঘণ্টার মধ্যে করা সম্ভব।

এফএএ-এর অপারেশনস বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ নিক ফুলার বলেন, যেহেতু দুর্ঘটনাটি প্রথমে প্রাণঘাতী বলে মনে হয়নি, তাই পরীক্ষা করা হয়নি। পরে সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় তা বাতিল করা হয়।

এফএএ জানায়, নিয়ন্ত্রক হেলিকপ্টারের উপস্থিতি যাত্রীবাহী বিমানকে জানানো উচিত ছিল।

যখন টাওয়ারে সংঘর্ষের সতর্ক সংকেত বাজে, তখন নিয়ন্ত্রক হেলিকপ্টার পাইলটদের বলেন, তারা কি বিমানের অবস্থান দেখতে পাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে। নিয়ন্ত্রক জানতেন, হেলিকপ্টার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু তিনি বিমানটিকে কিছু জানাননি।

দুর্ঘটনার পর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিয়ন্ত্রক বলেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না যে জানালেও ফল বদলাত কি না।

আরও জানা যায়, সংঘর্ষের আগে নিয়ন্ত্রকের নির্দেশ স্পষ্টভাবে শুনতে পাননি হেলিকপ্টারের পাইলটরা। যখন নিয়ন্ত্রক বলছিলেন, “বিমানের পেছন দিয়ে যান,” তখন হেলিকপ্টারের মাইক্রোফোন চাপা ছিল বলে পাইলটরা তা শুনতে পাননি।

সাবেক এনটিএসবি ও এফএএ তদন্ত কর্মকর্তা জেফ গুজেত্তি বলেন, এই দুর্ঘটনায় অনেকগুলো কারণ একসঙ্গে জড়িত—একে তিনি বলেন “সুইস চিজের মতো ছিদ্র এক লাইনে এসে মিলে গেছে”।

তিনি বলেন, যেকোনো একটি ছোট পরিবর্তন হলেও হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। যেমন: আরও নির্ভুল অল্টিমিটার ব্যবহার, বা ‘ADS-B আউট’ নামে পরিচিত ট্র্যাকিং যন্ত্র চালু রাখা—যা থাকলে নিয়ন্ত্রকরা সময়মতো সমস্যাটি দেখতে পারতেন।

“কয়েক ফুট কম বেশি হলেই হয়তো বিপদ এড়ানো যেত,” বলেন গুজেত্তি।

“একটা দুর্ঘটনা কখনোই একক ভুলে হয় না। এটা শুধু ‘পাইলটের ভুল’ নয় বা ‘কর্মী কম থাকা’র বিষয় নয়। এটা ছিল ভুলের পর ভুল—যা ঠিক একসময় গিয়ে একসঙ্গে হয়ে গেল।”

পরিবহন বিভাগের সাবেক মহাপরিদর্শক ম্যারি শিয়াভো বলেন, সেনাবাহিনী ও এফএএ উভয়েরই বড় দায় আছে।

তিনি বলেন, ব্ল্যাক হকের অল্টিমিটার ১০০ ফুট পর্যন্ত ভুল দেখাতে পারে—তা স্বাভাবিক ধরা হয়! তাদের ব্যবহৃত হেলিকপ্টার মডেল পুরোনো, যা উচ্চতা ধরে রাখতে হিমশিম খায়। পাইলটদের উড়ান নিয়ন্ত্রণ ছিল ঢিলে, তদারকি আরও ঢিলে।

“ব্যক্তিগতভাবে দায়ী তো বটেই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দায় সেনাবাহিনীরও,” বলেন তিনি।

শিয়াভো ক্ষুব্ধ হন এই দেখে যে, নিয়ন্ত্রকদের স্ক্রিনে হেলিকপ্টারের রুটের মানচিত্রই ছিল না—তাই জানালার বাইরে তাকিয়ে নির্ভর করতে হচ্ছিল।

তিনি বলেন, “সেনা হেলিকপ্টার চালনার প্রতিটি দিক বেসামরিক বিমান পরিবহনের মানদণ্ডে অনুপযুক্ত। এটা এক বিস্ময়কর উদাসীনতা।”

তিনি আরও বলেন, “আমি আগে থেকেই এফএএ-কে ‘কবরফলক সংস্থা’ (Tombstone Agency) বলতাম, কারণ তারা কেবল মৃত্যুর পরই ব্যবস্থা নেয়। ৩০ বছর পরও, দুঃখজনকভাবে, সেটাই সত্য।”

আবির

×