ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতিতে টানাপোড়েন, প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ২৪ জুন ২০২৫

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতিতে টানাপোড়েন, প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সদ্য কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি শুরুতেই চরম টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউস লনের সামনে দাঁড়িয়ে সংবাদকর্মীদের সামনে ট্রাম্প বলেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙেছে, তেমনি ইরানও। তবে ইসরায়েলের আচরণে তিনি ‘বিশেষভাবে অসন্তুষ্ট’।

যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় সোমবার রাতে, কয়েক দিনের টানা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর। ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলায় ইরানের ইসফাহান অঞ্চলের সামরিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করা হয়। পাল্টা জবাবে ড্রোন হামলা চালায় ইরান।

মঙ্গলবার সকালে ন্যাটো সম্মেলনের উদ্দেশে হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগে ট্রাম্প বলেন, “ইরান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, কিন্তু ইসরায়েলও করেছে। আমি তাদের নিয়ে খুশি নই। আমি ইরান নিয়েও খুশি না। কিন্তু আজ সকালে যদি ইসরায়েল আবার হামলা চালিয়ে থাকে, তবে আমি বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ।”

ট্রাম্প আরও বলেন, “আমাকে এখন ইসরায়েলকে শান্ত করতে হবে। আমরা চুক্তি করার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা যেন বোমার বন্যা বইয়ে দিলো, এমন বোমাবর্ষণ আমি জীবনে দেখিনি।”

নেদারল্যান্ডসের হেগে অনুষ্ঠিতব্য ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে হোয়াইট হাউস লনে ট্রাম্পের উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। তিনি বলেন, “দুই দেশ এত দিন ধরে, এত কঠোরভাবে যুদ্ধ করে এসেছে যে এখন তারা নিজেরাই জানে না আসলে কী করছে!”

যুদ্ধবিরতির একদিন আগে ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ অ্যাপে লেখেন, “যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর। ইসরায়েল আর ইরানে হামলা চালাবে না। সব বিমান ঘুরে যাবে, এবং ইরানের উদ্দেশে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে হাত নাড়বে। কেউ আহত হবে না।”

তবে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের একতরফা বোমাবর্ষণ দেখে ট্রাম্প রীতিমতো চটেছেন। মঙ্গলবার সকালে ট্রুথ সোশ্যাল-এ একটি পোস্টে তিনি লেখেন, “ISRAEL. DO NOT DROP THOSE BOMBS” – যদিও তিনি কোন নির্দিষ্ট বোমার কথা বলছেন, তা পরিষ্কার ছিল না। আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, “IF YOU DO IT IS A MAJOR VIOLATION. BRING YOUR PILOTS HOME, NOW!”

ট্রাম্পের এই প্রতিক্রিয়ার পরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি বিবৃতি দিয়ে জানান, ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে একটি হামলা চালানো হলেও, পরবর্তীতে আর কোনো আক্রমণ হবে না।

এর আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ জানান, ইরানের ‘জঘন্য যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের’ জবাবে তিনি তেহরানে নতুন হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

অন্যদিকে ইরান হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির সময়সীমা পেরিয়ে আরও দেড় ঘণ্টা ধরে আক্রমণ চালিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি জানান, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামলা না হলে তারা হামলা করবে না। তবে সামরিক অভিযান পুরোপুরি বন্ধ করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে।

যুদ্ধবিরতির শুরুটা ধাক্কাস্বরূপ হলেও ট্রাম্প পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তিনি ইরানে সরকার পরিবর্তন চান না এবং এখনো যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে বলে মনে করেন।

যদি এই যুদ্ধবিরতি টিকে থাকে, তবে এটি ট্রাম্পের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক জয় হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এর আগে তিনি ঝুঁকি নিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমারু বিমান পাঠানোর নির্দেশ দেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দাবি করেছে, ওইসব স্থাপনায় গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি হচ্ছিল।

তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা পূর্বে এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।

তেহরান থেকে আল-জাজিরার আলি হাসেম জানিয়েছেন, ইরানি কর্মকর্তারা ট্রাম্পের বক্তব্যকে কূটনৈতিক সম্ভাবনার জানালা হিসেবে দেখছেন। “এতে মনে হচ্ছে ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সত্যিই আন্তরিক,” বলেন হাসেম।

ওয়াশিংটন থেকে আল-জাজিরার ফিল লাভেল জানান, ট্রাম্প এখন ইসরায়েলের ওপর ‘প্রতারণার শিকার’ হয়েছেন বলেই মনে করছেন। “তিনি ইসরায়েল ও ইরান দুই পক্ষের ওপরই ক্ষুব্ধ, তবে ইসরায়েলের প্রতি ক্ষোভের মাত্রা ছিল বেশি,” বলেন লাভেল।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে ২৪ ঘণ্টা ধরে চলবে। প্রথমে ইরান তাদের সব অভিযান বন্ধ করবে, এরপর ১২ ঘণ্টা পরে ইসরায়েলও তা অনুসরণ করবে।

গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রও এতে অংশ নেয় শুক্রবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত এক অভিযানে, যেখানে ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করা হয়।

ইরান দাবি করেছে, এ পর্যন্ত দেশটির ৪০০ জনের বেশি মানুষ বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে মারা গেছেন ২৮ জন। এই প্রথমবারের মতো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিদিনের ভিত্তিতে ইসরায়েলের মার্কিন সহযোগিতায় গঠিত শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে।


যুদ্ধবিরতির ঘনঘটায় ট্রাম্পের প্রকাশ্য ক্ষোভ কূটনৈতিকভাবে নজিরবিহীন হলেও, এটা স্পষ্ট এই সংঘাতের নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় এবং প্রতিটি পরবর্তী পদক্ষেপ বিশ্বমঞ্চে গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা হবে। যুদ্ধ না চাইলে উভয় পক্ষকেই সংযম ও কৌশলিক ধৈর্যের পথে হাঁটতে হবে।


সূত্র:আল জাজিরা

আফরোজা

×