
ছবি: সংগৃহীত
উপমহাদেশে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছে। একদিকে পাকিস্তান, অন্যদিকে চীন— দুই দিক থেকেই সামরিক ও কূটনৈতিক চাপের মুখে পড়ছে ভারত। কাশ্মীরের প্যাহেলগামে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ভারতের পক্ষ থেকে সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করা এবং এর জবাবে পাকিস্তানের পাল্টা হুঁশিয়ারি, দু'দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সম্ভাবনাকে একেবারে উসকে দিয়েছে।
ভারতের সামরিক প্রস্তুতি ঘিরে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানকে হঠাৎ আক্রমণ করলে ভারতকে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হবে। কারণ, অতীতে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ভারতীয় বাহিনীর বিভিন্ন দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে যদি চীন সরাসরি পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে ভারতের জন্য এটি হবে এক বিধ্বংসী চ্যালেঞ্জ।
চীনের সামরিক শক্তি এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে। গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, চীনের সক্রিয় সেনা সংখ্যা ২০ লাখ, যেখানে ভারতের রয়েছে ১৪ লাখ ৪০ হাজার সেনা। সামরিক বাজেটেও বিশাল পার্থক্য—২০২৪ সালে চীনের বাজেট দাঁড়িয়েছে ২৪৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতের বাজেট মাত্র ৭৫ বিলিয়ন। চীনের হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র, স্টেলথ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান, উন্নত ড্রোন ও সাইবার যুদ্ধ সক্ষমতা, ভারতের জন্য এক দুঃস্বপ্নের নাম।
চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানকেও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করছে তুরস্ক। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, তুরস্কের বিমান বাহিনীর সাতটি কার্গো বিমান ইতিমধ্যে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। করাচিতে অবতরণ করা এসব বিমানে ছিল হাল্কা ও ভারী অস্ত্র। আরও ছয়টি বিমান আসার কথা নিশ্চিত করেছে পাকিস্তানি ও তুর্কি সূত্র।
এদিকে, পাকিস্তান বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে—যদি অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেও তারা পিছপা হবে না। পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসী ঘোষণা দিয়েছেন, ১৩০টি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে ভারতের জন্য। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও সরাসরি বলেছেন, পাকিস্তান সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে ভারত কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে চাইলে পাকিস্তান পাল্টা জবাবে সিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়। পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে যখন পাকিস্তান জানিয়ে দেয়, ভারতের যেকোনো পদক্ষেপকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এর জবাব দেওয়া হবে "প্রচলিত ও অপ্রচলিত" উভয় শক্তি দিয়ে।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খালিস্তানপন্থী আন্দোলন। শিখ নেতা গুরুপথ সিং পান্নু ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এক বার্তায় জানিয়েছেন, যদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে, তবে দুই কোটি শিখ পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাঞ্জাব ব্যবহার করে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে দেওয়া হবে না।
পান্নু মোদি সরকারকে একহাত নিয়ে বলেন, সংখ্যালঘুদের উপর দমননীতি ও কাশ্মীরে দখলদারির মাধ্যমে ভারত নিজের পায়ে কুড়াল মারছে। তিনি দাবি করেন, প্যাহেলগামে হামলা আসলে ভারত সরকারেরই সাজানো নাটক—যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় ও নির্বাচনী চিত্র পাল্টানো।
কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতেও ভারতের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বিবৃতিতে ভারতের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করে কেবল “সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর” কথা বলা হয়েছে। পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় “জম্মু ও কাশ্মীর” শব্দদ্বয় বিবৃতিতে যুক্ত হওয়ায় ভারতের অভ্যন্তরীণ ইমেজেও চাপ পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সামরিক সরঞ্জামের আধুনিকায়ন এখনো অসম্পূর্ণ। ২০১৮ সালে একটি সংসদীয় প্রতিবেদন জানিয়েছিল, ৬৮ শতাংশ অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরনো। ২০২৩ সালে সেই অনুপাত কিছুটা উন্নত হলেও, সেনাবাহিনীর চাহিদার তুলনায় তা এখনও অপর্যাপ্ত।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা নির্ধারণ করে দেবে দক্ষিণ এশিয়ার আগামী ভবিষ্যৎ। একদিকে চীনের কৌশলগত ছায়া, অন্যদিকে পাকিস্তানের পরমাণু হুমকি এবং অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের বিস্তার—সবকিছু মিলিয়ে ভারত এক জটিল সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে।
প্রশ্ন উঠছে, কূটনৈতিক বিচক্ষণতা না থাকলে, এই দ্বিমুখী চাপে ভারত তার আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে তো?
ভিডিও দেখুন: https://www.youtube.com/watch?v=Bq4YFvdhfYA
এম.কে.