ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাও সেতুং এর পথে শি জিনপিং

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মাও সেতুং এর পথে শি জিনপিং

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শেষ পর্যন্ত মাও সেতুং এর পুরনো পথই বেছে নিলেন। পাঁচ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সে লক্ষণ প্রতিভাত হচ্ছিল। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি রবিবার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছে। পার্টি শি’র হাতে সীমাহীন ক্ষমতা অর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এর ফলে ভবিষ্যতে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা আছে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে সীমাহীন ক্ষমতা পরবর্তী পর্যায়ে শি’র দুর্বলতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ তিনি তখন কাউকে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার সুযোগ নাও দিতে পারেন। এটি বিশ্বের জনবহুল দেশটিকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। পার্টি তথন কেবল শি’র কথায় চলবে। স্বাভাবিকভাবে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি হবেন না। অর্থনৈতিক বা বৈদেশিক ক্ষেত্রে কোন সঙ্কট দেখা দিলে তার পুরো দায় তাকে নিতে হবে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি হওয়ার সম্ভবনা বেশি বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এশিয়ার সুপার পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ১৯৭৬ সালে মাও সেতুং এর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরীরা এক ব্যক্তির শাসন থেকে পার্র্টির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মুষ্ঠিমেয়র শাসন প্রবর্তন করেছিল। মাওয়ের সময় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিণতিতে দেশটিতে গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছিল। মাওয়ের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন থেকে শি’র পূর্বসূরী হু জিনতাও পর্যন্ত এই নিয়ম বহাল ছিল। দুজনের প্রত্যেকেই পাঁচ করে পরপর দুই মেয়াদ শাসন করে গেছেন। পার্টির সর্বশেষ প্রস্তাবটি গৃহীত হলে শি’র ক্ষমতা কেবল দু মেয়াদে সীমিত থাকবে না তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই শি নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে চলেন। তিনি যে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেন সেরকম আভাস শুরু থেকেই পাওয়া যায়। তিনি অনির্দিষ্টকাল ধরে ক্ষমতায় থাকলে চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতির যেমন অবনতি ঘটতে পারে তেমনি বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে পারে। ‘চায়না এন্ড নিউ মাওয়িস্ট’ বইয়ের সহ লেখক সাইমন ভান নিউওয়েনহুইজেন বলছেন, দেশের মধ্যেও শি অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। তিনি বলেন, ‘দুই মেয়াদের ক্ষমতা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে। কিন্তু ১০ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকলে জনতা এবং রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তখন শি’র কর্মকান্ড খুঁটিয়ে দেখবে।’ শি’র দুই পূর্বসূরী জিয়াংজেমিন এবং হু জিনতাও দুই দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে শাসন ব্যবস্থাকে যেমন স্থিতিশীল রেখেছেন তেমনি চীনকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ সুগম করেছিলেন। কিন্তু ৬৪ বছর বয়সী শি পূর্বসূরীদের পথে হাঁটবেন না বলেই অনুমান করা যায়। তিনি মাওয়ের যুগকে যেন ফিরিয়ে আনতে চান। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সুশীল সমাজকে বশে আনার চেষ্টা করেছেন। দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং তৈরি করেছেন নিজের একান্ত অনুগত একটি মহল। পার্টি সংবিধানেও মাওয়ের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে শি’র নিজস্ব তত্ত্ব। ‘শি জিনপিং থট’ নামে এটি গত বছর পার্টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সিল্করুট নামে পরিচিত প্রাচীন বাণিজ্য রুট আধুনিক সময়ের উপযোগী করে বেল্ট এন্ড ইনিশিয়েটিভ গড়ার উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। এছাড়া শি’র অন্যতম লক্ষ্য চীনের সেনাবাহিনীকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। গত বছর পার্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শি’র উত্তরসূরী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা ছাড়াই শেষ হয়েছে। তিনি যে ২০২৩ সালের পরও ক্ষমতায় থেকে যেতে ইচ্ছুক এ থেকে তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সেটন হল ইউনিভার্সিটির চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও আইনের প্রফেসর মার্গারেট বলেন, ‘শি’র সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি কারও সঙ্গেই এমন কি পার্টির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও ক্ষমতা ভাগাভাগি করছেন না। ক্ষমতা সুসংহত রাখাই তার শাসনামালের প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ এটি দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ চীনে প্রথাগত অর্থে গণতন্ত্র নেই। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ভেতর কিছু ভারসাম্যপূর্ণ নিয়ম রাখা হয়েছে যাতে কেউ একচ্ছত্র হয়ে উঠতে না পারে। এর ভেতরে থেকেই দলের রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্থী অংশ যার যার অবস্থান ধরে রেখেছে। এই ভারসাম্যের নীতি চীনা কমিউনিস্ট পাটিতে গত ৩৫ বছর অনুসরণ করে আসছে। বিশ্বের অনেক দেশে কমিউনিজমের পতন হলেও চীনে এর পতন না হওয়ার অন্যতম কারণএটাই, ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের চায়না পলিসি ইনস্টিটিউটের পরিচালক জন সুলিভান তাই মনে করেন। তাই শি যদি সেখান থেকে সরে আসেন তার মূল্য তাকে দিতে হতে পারে।
×