ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

যুদ্ধ থামাতে ইরানের সামনে কী কী পথ খোলা আছে?

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২০ জুন ২০২৫

যুদ্ধ থামাতে ইরানের সামনে কী কী পথ খোলা আছে?

ছ‌বি: সংগৃহীত

ইসরায়েল ও ইরানের চলমান যুদ্ধ থামাতে তেহরানের সামনে কার্যকর কোনো পথ আপাতত খোলা নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে ইরান যদি উত্তেজনা বাড়ায়, তাহলে আরও বড় আঘাত আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দিক থেকে। ফলে যুদ্ধ থামানোর জন্য ‘উত্তেজনা বাড়িয়ে শান্তি আনা’— এই কৌশলও বড় ঝুঁকির।

গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল অন্তত ৫ শতাধিক ইরানিকে হত্যা করেছে, যাদের অনেকে সাধারণ নাগরিক। নিহতদের মধ্যে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন। ইসরায়েল ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন, হাসপাতাল, অ্যাপার্টমেন্ট ভবন এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনেছে।

জবাবে ইরানও বলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক ও নিরাপত্তা স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে হাইফার একটি তেল শোধনাগার, আবাসিক ভবন ও একটি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা নয়, বরং সেখানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনও চায় তারা। এ ধরনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থাকায় ইরানের জন্য দ্রুত কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানো কঠিন। ইরানের সরকার বলেছে, হামলার মধ্যে কোনো আলোচনায় তারা যাবে না, কারণ এতে আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কোনো পথ থাকবে না।

তবে কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইসরায়েলকে থামাতে পারেন, তাহলে ইরান যুদ্ধ বন্ধে আগ্রহ দেখাতে পারে। কারণ ইরানের মূল লক্ষ্য যুদ্ধ বাড়ানো নয়, যুদ্ধ থামানো।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক হামিদরেজা আজিজ বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে থামাতে পারে এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝে, তাহলে ইরান একটি রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত হতে পারে।”

তাত্ত্বিকভাবে ইরান আবারো আলোচনায় বসতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ চলার মধ্যেই তা হলে ইরানকে তার পুরো পারমাণবিক কর্মসূচি ছেড়ে দিতে হবে, যা তাকে প্রতিপক্ষের হাতের মুঠোয় দিয়ে দেবে। এই শর্তে কোনো চুক্তি ইরান করবে না বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষক রেজা হাকবারি বলেন, “ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সেটি পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া এখন অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে।”

ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পাঁচবার আলোচনায় বসেছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করার শর্তে চুক্তি করতে চায়, যা ইরানের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

ইরানের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, প্রতিটি হামলার পর পাল্টা হামলা চালিয়ে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছে দেশটি। বিশ্লেষক নেগার মোরতাজাভি বলছেন, “প্রতিবার ইরান প্রতিশোধ নেয়, তখন ইসরায়েলের জন্য নতুন করে হামলার অজুহাত তৈরি হয়।”

ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবও এখন অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এক সময় ইরানের বড় ভরসা ছিল লেবাননের হিজবুল্লাহ, যারা এখন ইসরায়েলের সঙ্গে এক বছরের যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় ইরান আরেকটি বড় মিত্র হারিয়েছে।

তবে এখনো ইরান মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে থাকা নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে আঘাত হানার সুযোগ রাখে। বিশেষ করে ইরাকের ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।

কিন্তু এমন পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনতে পারে, যা ইরানের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

ইরানের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো— যুদ্ধ শুরু করায় ইসরায়েলের ওপর রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হাসান আহমাদিয়ান বলেন, “ইরান বিশ্বাস করে তারা এতটা আঘাত দিতে পারবে যে ইসরায়েল বাধ্য হবে থেমে যেতে।”

তবে ইরান কতটা ক্ষতি করতে পারছে, তা জানা কঠিন। কারণ ইসরায়েল তাদের সামরিক ক্ষতির খবর প্রকাশ করে না। অপরদিকে, ইরান কতদিন এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে, তাও অনিশ্চিত।

ইসরায়েলও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালাতে পারবে না। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, যা ইরানকে বাড়তি সুযোগ দিতে পারে।

সব মিলিয়ে, দুই পক্ষই বড় চাপের মুখে আছে। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে উভয়ের ক্ষতি বাড়বে—এই বিশ্বাস থেকেই ইরান হয়তো আশা করছে, পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় যাবে যেখানে যুদ্ধ আপনা থেকেই থেমে যাবে।

বিশ্লেষক বারবারা স্লাভিন বলেন, “ইরান এখন কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বাইরের কেউ এসে তাদের রক্ষা করবে না। নিজেদেরই পথ খুঁজে নিতে হবে।”

সূত্র: আল জাজিরা

এম.কে.

×