
ছবি: সংগৃহীত
আজ সকালের ইরানি হামলাটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় বড়সড় বৃদ্ধি দেখা যায়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান এতদিন পুরনো মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করলেও এখন ধীরে ধীরে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিসাইল মাঠে নামাচ্ছে, যেগুলোর নিখুঁততা ও ধ্বংসক্ষমতা তুলনামূলক অনেক বেশি।
“টেস্ট ম্যাচ” স্টাইলের যুদ্ধ?
এই হামলা কেবল একবারের প্রতিশোধ নয়—একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত যুদ্ধের সূচনা বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। ধীরে ধীরে হামলা বাড়িয়ে ইরান যেন সময়ের খেলায় ব্যস্ত, যার ফলে ইসরায়েলের ওপর সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে প্রতিদিন।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী—
২৪ জন নিহত।
প্রায় ৮০০ জন আহত (ভিন্নসূত্রে ২৮৭–৮৩৮ পর্যন্ত)।
৫০০০ জন আশ্রয় নিয়েছেন শেল্টারে।
জনসংখ্যার অনুপাতে ধ্বংসের হিসাব:
এই যুদ্ধে একেবারে নতুন মাত্রা যোগ করছে জনসংখ্যার বিষয়টি। ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি পক্ষান্তরে ইরানের জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি।
অর্থাৎ জনসংখ্যার দিক থেকে ১ জন ইসরায়েলি প্রাণহানি মানে ১০ জন ইরানির সমান চাপ—সামরিকভাবে নয়, বরং রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে। এই অনুপাত বিবেচনায় রেখে ক্ষয়ক্ষতির মানে আরও গভীর।
সরোকা হাসপাতালের নিচে মিলিটারি বেস?
হামলার অন্যতম লক্ষ্যে ছিল ইসরায়েলের বিয়ারশেভা শহরের সরোকা মেডিক্যাল সেন্টার। ধারণা করা হচ্ছে, ওই হাসপাতালের নিচে সামরিক ঘাঁটি থাকার প্রমাণ পেয়েই সেখানে আঘাত হানা হয়। এতে কমপক্ষে ৫০–৮০ জন আহত হন। আঘাতের ভয়াবহতা আরও বাড়তো যদি আগে থেকেই হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আংশিক খালি করার উদ্যোগ না নেওয়া হতো।
তথ্য নিয়ন্ত্রণে কড়া নজরদারি:
ইসরায়েল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তথ্য বের হতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দাবি, গত কয়েকদিন ধরে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা, লাইভ কাভারেজ বন্ধ করে দেওয়া, এমনকি গ্রেফতার বা সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। যদিও আজকের দিনে নির্দিষ্ট কোনো সাংবাদিক আটকের খবর পাওয়া যায়নি, তবে আল জাজিরা ও টিআরটি ওয়ার্ল্ডের সাংবাদিকদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়—তথ্য নিয়ন্ত্রণের এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করছে।
চীন ও রাশিয়া কূটনৈতিক সমাধানে জোর দিচ্ছে।
জাতিসংঘ পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
নেতানিয়াহুর চাপে পড়ার সম্ভাবনা:
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানের সাবেক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেয়েম আমিনাখ জানান, এই যুদ্ধের সরাসরি সামরিক ব্যয় প্রতিদিন গড়ে ৭২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার লড়াইয়ে ইসরাইলের খরচ হয়েছে প্রায় দেড়শ কোটি ডলার। যার অর্ধেকই খরচ হয়েছে প্রতিরক্ষায় আর বাকিটা হামলায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই ভেঙে পড়ছে ইসরাইলের বাজেট কাঠামো। প্রতিদিনের শত শত মিলিয়ন ডলারের ব্যয় জনগণের উপর চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে বাজেট ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতি দেশটির অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সামনে এখন ত্রিমুখী চাপ—যুদ্ধের সামরিক ব্যয়, অভ্যন্তরীণ জনরোষ, আর আন্তর্জাতিক সমালোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ যদি দ্রুত শেষ না হয়, তবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক গিদিওন লেভি মন্তব্য করেছেন, "নেতানিয়াহু হয়তো যুদ্ধকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাইছেন, কিন্তু যুদ্ধ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে সেটিই হতে পারে তার রাজনৈতিক পতনের কারণ।"
এই যুদ্ধ কেবলমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় নয়—এটি প্রযুক্তি, কৌশল, জনমনের মনস্তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের জটিল খেলা। সময় যত যাবে, ক্ষয়ক্ষতির মাপকাঠিও ততই বদলাবে। এখন দেখার বিষয়—কে আগে ক্লান্ত হয়, আর কে কৌশলে জিতে নেয় এই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ।
সাব্বির