
ডায়াবেটিস ও কোলন ক্যান্সার দুটিই সাধারণ কিন্তু মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা। আধুনিক গবেষণা বলছে, এই দুটি রোগের মধ্যে একটি দ্বিমুখী সম্পর্ক রয়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। আবার কোলন ক্যান্সার ও তার চিকিৎসা প্রক্রিয়া ডায়াবেটিসকে আরও জটিল করে তুলতে পারে, এমনকি নতুন করে ডায়াবেটিস সৃষ্টি করতেও পারে।
এ দুটি অসুস্থতার পেছনে কিছু অভিন্ন জীবনধারাজনিত ঝুঁকিও কাজ করে। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই হতে পারে এই দুই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।
এই দুই রোগের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির মূল কারণ ইনসুলিন প্রতিরোধ, উচ্চ রক্তে চিনি এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ না করায় রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অগ্ন্যাশয় অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরণ করতে থাকে। ফলে তৈরি হয় হাইপারইনসুলিনেমিয়া, যা শরীরে ইনসুলিন-সদৃশ হরমোন IGF-1 বৃদ্ধি করে এটি কোলন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সহায়ক।
অন্যদিকে, উচ্চ রক্তে চিনি বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া ক্যান্সার কোষের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য জ্বালানি সরবরাহ করে। এছাড়া এটি কোষীয় বিপাকক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিনের মাত্রা বাড়ায়, যা কোলন ক্যান্সার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহও এই সম্পর্কের একটি বড় কারণ। প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়াগুলো শরীরজুড়ে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করে, যা কোষ ক্ষতির মাধ্যমে ক্যান্সার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া অন্ত্রে প্রদাহজনিত ভারসাম্যহীনতা এবং অস্বাভাবিক গাট মাইক্রোবায়োম কোলন টিউমার বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত।
ঝুঁকি কতটা?
২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ১.৩ গুণ বেশি। আরও একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ডায়াবেটিস থাকা এমনই একটি ঝুঁকি, যা পরিবারের ক্যান্সার ইতিহাসের মতোই গুরুত্ব রাখে বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস ৫০ বছরের আগেই ধরা পড়ে।
২০২৩ সালে প্রকাশিত JAMA Network Open-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আফ্রিকান আমেরিকানদের কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৪৭ শতাংশ বেশি।
সাধারণ ঝুঁকির কারণ
টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও কোলন ক্যান্সারের পেছনে নিচের সাধারণ ঝুঁকিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে:
বংশগত জেনেটিক ভ্যারিয়েন্টস: কিছু জিনগত রূপান্তর টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও কোলন ক্যান্সার উভয়ের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা: এটি ইনসুলিন প্রতিরোধ ও উচ্চ রক্তচিনির মূল উৎস, যা দুটি রোগেরই ঝুঁকি বাড়ায়।
জীবনধারাগত কারণ: শরীরচর্চার অভাব, ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন সবই এই দুই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
চিকিৎসা ও জটিলতা
এই দুই রোগের সম্পর্ক জটিল এবং একইসঙ্গে চিকিৎসা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।ডায়াবেটিসের চিকিৎসা: রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণই প্রধান লক্ষ্য। প্রতিদিনের জীবনধারা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা চলে।
কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা: রোগের স্তরের ওপর নির্ভর করে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। অনেক সময় এই চিকিৎসাগুলো ডায়াবেটিসকে আরও জটিল করে তোলে বা নতুন করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস তৈরি করে। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন স্নায়ুর ক্ষতি, কিডনি বা হৃদরোগ সবই ডায়াবেটিসের সঙ্গে মিল রয়েছে, যা ঝুঁকিকে দ্বিগুণ করে তোলে।
প্রতিরোধের উপায়
রোগ প্রতিরোধে জীবনধারায় পরিবর্তন সবচেয়ে কার্যকর।
স্ক্রিনিং: ৪৫ বছর বয়সের পর নিয়মিত কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও রক্তে চিনির পরীক্ষা করা জরুরি।
সুস্থ খাদ্যাভ্যাস: কম চর্বিযুক্ত, বেশি ফল, সবজি, বাদাম, ডাল, মাছ, এবং চর্বিহীন প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
নিয়মিত শরীরচর্চা: এটি কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসে A1C কমাতে সাহায্য করে, এমনকি ওজন না কমলেও।
অ্যালকোহল ও ধূমপান ত্যাগ: অ্যালকোহল ক্যান্সার ও নিম্ন রক্তচিনির ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান এড়িয়ে চলা আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসা নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
সুস্থ ওজন বজায় রাখা: অতিরিক্ত ওজন রক্তচিনি বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস ও কোলন ক্যান্সার উভয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিস ও কোলন ক্যান্সার দুটিই আজকের বিশ্বে সাধারণ কিন্তু বিপজ্জনক রোগ। একটির উপস্থিতি অন্যটির ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং চিকিৎসার সময়ও একে অপরকে প্রভাবিত করে। তবে দুটির ক্ষেত্রেই কিছু সাধারণ জীবনধারাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতা থাকলে, একসাথে এই দুই রোগ মোকাবিলা করাও সম্ভব।
সূত্র:https://tinyurl.com/29pwvtnw
আফরোজা